Sunday 26 August 2018

ক্রেবসের সাইকেল

২৫ শে অগাস্ট, ২০১৮

পুরোনোতুন সাইকেলটা

সাইকেলটা আমাদের সব্বার ইস্কুলে ছিল, আছে অনেকদিন ধরেই, না না, এ জিনিস সদ্য পাওয়া সবুজসাথীর নয়, এ অনেক পুরোনো। আমরা, পছন্দ করি বা না করি, এটা প্রায় সবাইকেই চড়তে হয়েছে, এখন অবিশ্যি আমি চড়াই, নিজে চড়ে কদ্দূর এক্সপার্ট হইচি সে বলা যায় না।

দাঁড়ান, সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে আপনাকে একটা ছবি দেখাই। ঘ্যাং! নীচের প্রথম ছবিটা একটা যন্তরের। এ দিয়ে মাপা হয় কোষের শ্বাস-প্রশ্বাস। হ্যাঁ, সেই কোষ, যে গুলো ইঁটের পরে ইঁটের মতো গেঁথে তৈরী হয় আমার আপনার যাকে বলে বডি! বডিকে জ্যান্ত থাকতে গেলে কোষকে জ্যান্ত থাকতে হবে। কোষ যে জ্যান্ত তার প্রমাণ সেটা বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়। কেন নেয়? কোষের মধ্যে থাকে পাওয়ার প্যাক গ্লুকোজ, তাকে এই অক্সিজেন ভাঙবে, ভাঙলে বেরবে শক্তি, সেই শক্তির দাক্ষিণ্যে কোষের যত কায়দাবাজি, লম্ফঝম্প, ইত্যাদি। আর তার থেকেই আমরা জ্যান্ত মানুষ! তো এই কোষগুলো কতটা করে অক্সিজেন নেয়, সেটা মাপার এই হল সীল-করা যন্তর, যাকে বলে রেসপিরোমিটার, রেসপিরেশন মানে যেহেতু শ্বসন। যন্তরটার ভেতরে জ্যান্ত কোষ আছে, অণুজীব বা টিস্যুর অংশবিশেষ, টিস্যু মানে একরকম কোষেদের পরিবার, বাংলায় যাকে বলে কলা। তো তারা অক্সিজেন নিলে ছাড়বে কার্বন ডাই অক্সাইড, সেই গ্যাস শুষে নেবার মত একরকম রাসায়নিক রাখা আছে যন্তরটার ভেতরে। সেটা সোডা লাইম কিংবা কস্টিক পটাশ হতে পারে। ব্যাপার হল সীল করা যন্তরের ভেতরের অক্সিজেন গ্যাস যদি শুষে নেয় কোষ, আর কোষ থেকে বেরনো কার্বন ডাই অক্সাইড যদি শুষে নেয় সোডা লাইম বা কস্টিক পটাশ, তাহলে ভেতরে আর গ্যাস বলতে থাকলো কি! এর মানে ভেতরের বাতাসের চাপ কমতে থাকবে। কতটা কমলো দেখার জন্যে এর সাথে জোড়া আছে একটা ইউ আকৃতির কাচনল, যাতে আছে খানিকটা রঙিন তরল, যন্তরটার ভেতরের গ্যাসের চাপ কমা বাড়া করলে সেই তরলটা টিউব দিয়ে এপাশে ওপাশে নড়াচড়া করবে। একে বলে ম্যানোমিটার, চাপ মাপার যন্তর। এইভাবে চাপ মেপে বোঝা যায় কোষে কতটা অক্সিজেন নিচ্ছে, তার থেকে বার করা যায় কোষের শ্বসনের হার। এই রেসপিরোমিটারের আইডিয়া নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জার্মানীর বায়োকেমিস্ট অটো ভারবুর্গের, যাঁর ল্যাবে কাজ করতেন আমাদের ওই সাইকেলের মালিক ডাক্তারবাবুটি।

কোষ অক্সিজেন নিয়ে গ্লুকোজকে দড়াম করে একধাপে ভেঙে ফেলতে পারে না! পদ্ধতিটা হয় ধাপে ধাপে। এতে অনেকরকম বিক্রিয়া ঘটে। সেইসব বিক্রিয়া ঘটাতে দরকার হয় অনেকরকমের উত্সেচক, যারা বিক্রিয়াগুলোকে তাড়াতাড়ি ঘটাতে সাহায্য করে, অনেকটা একশোদিনের কাজে মাটিকাটার পরে যেরকম সারি সারি শ্রমিক লাইন দিয়ে সেই মাটির ঝুড়ি একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে দেন, সেরকম। প্রতিবার ঝুড়ি হস্তান্তরের সময় ইলেকট্রন আদানপ্রদান ঘটে অণুদের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। এইসব উত্সেচক নিয়ে কাজ করে ১৯৩১ সালে ভারবুর্গ সাহেব চিকিত্সাবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পান। কিন্তু তখনো কোষীয় শ্বসনের সম্পূর্ণ ধাপগুলো বিজ্ঞানীরা জেনে উঠতে পারেন নি। প্রথম ধাপটা ঘটে কোষের সাইটোপ্লাজমে। কোষ যদি কাঁচা ডিম হয়, তবে লিকুইড অংশটা তার সাইটোপ্লাজম। এরপরের ধাপে কি থেকে কি হয় সেটার একটা ভাসাভাসা তথ্য ছিলো, কিন্তু ভারবুর্গের সুযোগ্য শিষ্য, আমাদের ডাক্তারবাবুটি যখন বললেন, তিনি ওই রেসপিরোমিটার দিয়েই রহস্য গোটাটাই ভেদ করবেন, ভারবুর্গ পাত্তা দেন নি। বিশ্বাসই করেন নি।

প্রথম ধাপের তৈরী পদার্থগুলো দ্বিতীয় ধাপে কোষের একরকম অঙ্গাণুতে ঢোকে, যার নাম মাইটোকনড্রিয়ন। এখন যেহেতু বাইরে থেকে বিক্রিয়াটাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু ধাপে ধাপে কি পরিবর্তন হচ্ছে দেখার জন্য ডাক্তার এক কায়দা বার করলেন।

শুনতে সহজ লাগলেও ব্যাপার অত সহজ নয়। আগের গবেষণা পড়ে একটা ধারণা তৈরী হয়েছিল যে কী কী উত্সেচক এই কাজে লিপ্ত থাকতে পারে। এটাও বোঝা গেছিল যে দ্বিতীয় ধাপটা একটা চক্রাকারে ঘটা বিক্রিয়ার সমাবেশ। পায়রার বুকের পেশী, যা পায়রাকে উড়তে সাহায্য করে, আর সহজে কখনো ক্লান্ত হয় না, সেই পেশীর কোষ রেসপিরোমিটারে নিয়ে কাজ চালালেন তিনি। একেকবার একেকরকম উত্সেচক ব্যবহার করে করে দেখতে হচ্ছিল কোষের শ্বসনহার কিভাবে প্রভাবিত হয়। তার সাথে কোষটা কি কি রাসায়নিক তৈরী করছে সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হলো। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতির নিষ্ঠাসহকারে পালন, আর কি! এইভাবে দ্বিতীয় ধাপের চক্রটার সবকটা পর্যায় ক্রমশঃ পরিষ্কার হলো। এই ধাপেই তৈরী হয় কার্বন ডাই অক্সাইড, আর বাকি জিনিস গুলো শেষধাপের বিক্রিয়া ঘটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ডাক্তারবাবু গবেষণালব্ধ ফল সংক্ষেপে লিখে প্রকাশ করতে গেলেন বিখ্যাত জার্নাল নেচার-এ, সেখানে বলা হল, লেখা প্রকাশের জায়গা আর খালি নেই। শেষটায় অন্য  এক পত্রিকায় বড়ো আকারে ছেপে বেরলো এই গবেষণাঃ উচ্চ শ্রেণীর জীবের কোষে বাতাসের সাহায্যে কিভাবে শ্বসন ঘটে তার সদ্য আবিষ্কৃত ধাপ। খাবার খেয়ে পাওয়া শক্তির দুইতৃতীয়াংশ শক্তির জন্ম হয় এই বিক্রিয়াচক্র থেকে। সেই চক্রের রহস্যকে জানা পৃথিবীর ইতিহাসে বিশাল একটা অবদান তো বটেই। সেজন্য ১৯৫৩ সালে ডাক্তারবাবু চিকিত্সাবিজ্ঞানে পেলেন নোবেল পুরস্কার।

এইবার আসল মজার তথ্য, এ রহস্যকে জানার শুরু হয়েছিল জার্মানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে, শেষ হলো ইংলন্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে! কারণ, একমেবদ্বিতীয়ম, শ্রীযুক্ত অ্যাডলফ হিটলার!

ডাক্তারবাবু যখন জার্মানীতে গবেষণা এবং হাসপাতালের কাজ সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় অলরেডি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। জার্মানী থেকে অজার্মানী সবাইকে গলাধাক্কা দেবার ফরমান জারি করেছেন হিটলার সায়েব, যিনি বলেছিলেন, “বিশুদ্ধ জার্মান থাকবে কেবল, ইহুদী বৈজ্ঞানিক চলে গেলে জার্মানী যদি বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে, সেও আচ্ছা!” ইহুদী বংশের ডাক্তারবাবুটিও ধাক্কা খেলেন। ইংলন্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লুফে নিলেন রত্নটিকে। মানুষের লিভারে কিভাবে ইউরিয়া তৈরী হয় তা আবিষ্কার করে তিনি তদ্দিনে বিখ্যাত। এ রকম গুণী মানুষকে নিজের দেশ ঠুকরালে কি হবে, বুঝদার দেশ সযত্নে টেনে নেবে।

নিলও তাই। কিন্তু দেশ ছাড়ার আগে সেসময় সব দিয়ে যেতে হচ্ছিলো বিজ্ঞানীদের, ভিনদেশে কোন গবেষণা বা যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে দেবে না নাজি অফিসারবর্গ। লুকিয়ে চুরিয়ে যা নেবার নেওয়া যায়, কিন্তু ভারবুর্গের ডিজাইন করা ওই অতোবড়ো রেসপিরোমিটার? ওটা না হলে যে ডাক্তারবাবুর সব গবেষণাই মাটি হয়ে যাবে!

শেষমেষ নাজি অফিসারেরা সদয় হয়েছিলেন। সেদিন ভাগ্যের জোরে তাদের বদান্যতা না পেলে ডাক্তার হ্যান্স ক্রেবসের আর কোষীয় শ্বসনের দ্বিতীয় ধাপ আবিষ্কার করা হতো না ইংলন্ডে এসে! জীবনবিজ্ঞান পিছিয়ে যেত হয়তো, হয়তো কেউ না কেউ আবিষ্কার করতেন, কিন্তু ডাঃ ক্রেবসের মতন তৈরী মনন কি পাওয়া যেত? আর কে না জানে, তৈরী মনই সুযোগের সদ্ব্যবহারে সক্ষম।

আজ্ঞে ঠিকই ধরেছেন মশাই, এই সাইকেলটা ডাঃ হ্যান্স ক্রেবসের, ক্রেবস সাইকেল! সবার ইস্কুলেই ছিল, তবে উঠোনে নয়, জীবনবিজ্ঞানের বইতে, শ্বসনের চ্যাপ্টারে। সবাই অল্পবিস্তর চড়েছেন, এখন হয়তো ছানাপোনাদের চড়াচ্ছেন। আজ ডাক্তারবাবুর জন্মদিন কি না, বেঁচে থাকলে আজ তাঁর একশো আঠারো বছর বয়স হতো, তাই বললাম, নমস্কার, চলি তাহলে, আবার দেখা হবে। ক্রিং ক্রিং।

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Sunday 19 August 2018

ঘোরতর প্যাঁচালো কান্ড (দুই)

ঘোরতর প্যাঁচালো কান্ড (দুই)

ম্যাও সামলানো মোটেই সহজ কাজ নয়, বিশেষতঃ সেটা যদি শ্রোয়েডিংগারের ম্যাও হয়! আর এই শ্রোয়েডিংগারের ম্যাও মানে বেড়ালের চক্করে পড়ে বাঘা বাঘা পদার্থবিদেরই চেতনা চটকে যায় তো কোথায় আমাদের মত ছাপোষা লোক! সেই সময় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভয়ঙ্কর সব গাণিতিক চিহ্নদের ওপর থেকে নজর সরে যায়, ইচ্ছে করে না বড়ো বড়ো সমীকরণগুলো আর তার বাস্তব তাত্পর্য্যগুলোর দিকে তাকাতে, আর ঠিক তখনই, বিজ্ঞান-বিষয়ক চমকপ্রদ তথ্য সরবরাহকারী সংস্থার উল্টোপাল্টা প্রচারের ফলে, প্রকৃত মানে ভুলে গিয়ে সামান্য কতগুলো করোলারির উপরে বেশি বেশি করে গুরুত্ব আরোপিত হয়। তাতে করে চমত্কার চমত্কার সব তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণী বেরোয়! তার বিষয়ে নানা বিদগ্ধ মুনিদের নানা মত থাকতেই পারে, কিন্তু এই মতামতের বিবাদের মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ছদ্মবিজ্ঞান নামক একরকম ক্ষতিকর বিষয়! কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, বলা বাহুল্য, অজস্রবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এইরকম ছদ্মবিজ্ঞানের বিষাক্ত তীরে। সঙ্গত কারণেই, বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের পক্ষেও জনমানসে গেড়ে বসা এইসব ছদ্মবিজ্ঞানের ম্যাও সামলানো মোটেই সহজ নয়। তখন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী নন, নির্মোহচিত্তে নিরলসভাবে হাতে কলমে গবেষণা করে যাওয়া বিজ্ঞানীর দলই পারেন সেই ম্যাও তাড়াতে। বাস্তবিক তাঁরা কোন বড় বড় তত্ত্ব কাগজে লিখে শুধু দেখান না, তাঁরা বলেন, ‘পরীক্ষা করে আমরা এই পেয়েছি, এবার তুমি বা তোমরা সামলাও কিভাবে থিওরি দিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবে বাপু! আমাদের কাজ ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, এবার সেটা তোমাদের পোষালে পোষাক, না পোষালে কেটে পড়ো, কিন্তু ফলাফল ধ্রুব সত্য’। আর এইভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে তত্ত্বের পর তত্ত্ব পরিশোধন করতে করতে, তাতে কোন জিনিয়াসই অবশ্য ভুল কি ঠিক প্রমাণিত হয় না, নির্মোহভাবে এগিয়ে চলাই বিজ্ঞানের পথ, আর নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে নিরপেক্ষ ভাবে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের বর্তমান পরিস্থিতি প্রচার করাই হল বিজ্ঞান সাংবাদিকের ধর্ম, কিভাবে কি এসেছিল, তার পর্যালোচনা করুন বিজ্ঞানের ইতিহাসবেত্তারা, সাংবাদিকের সে দায় নয়, কারণ না হলে আংশিক সত্য পরিবেশন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে! আর সত্য পুরো সামনে না এলেই ছদ্মসত্য সৃষ্টির একশোভাগ সম্ভাবনা।

প্রথম সমস্যা হল সাহিত্যিক সেক্সপিয়ারকে নিয়ে। হোয়াটস ইন এ নেম নয়, হে মনীষী, বলুন হোয়াটস নট ইন এ নেম,  গোলাপকে যে নামে ডাকুন তা গোলাপই থাকবে,  কিন্তু আমাদের কোয়ান্টাম কথাটি এতই রহস্যরোমাঞ্চকর লাগে যে কোথাও ব্যবহার করতে পারলে বেশ গুরুগম্ভীর মনে হয় নিজেকে। এ প্রসঙ্গে একটা কার্টুন মনে পড়ে গেল,  জজসায়েব উকিলকে জিগ্যেস করছেন,  মামলার ব্যাপারে কদ্দূর এগোলেন? এজলাসের আবহাওয়া ভারিক্কি করার জন্য উকিলরা প্রায়ই গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহার করে থাকেন,  এ ক্ষেত্রে তিনি বললেন, সামগ্রিক দলিল দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে মামলার কোয়ান্টাম অগ্রগতি ঘটেছে। জজসায়েব যৌবনে পেটেন্ট অফিসের উকিল ছিলেন,  ওনাকে একবার এক কোয়ান্টাম বিশারদের আবিষ্কারের পেটেন্ট করানোর কথা বলা হয়েছিল, উনি বোর্ড ভর্তি অদ্ভূত সব চিহ্ন দেখে অজ্ঞান হয়ে ক্লায়েন্ট হাতছাড়া করেন, তাই আজো সেই ভয়ে বা সম্ভ্রমে, বর্তমান উকিলকে কোয়ান্টাম অগ্রগতি নিয়ে খুঁচালেন না। উল্টে নোট নিলেন,  মামলার কোয়ান্টাম অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাস্তবে, কোয়ান্টাম মানে এত স্বল্প পরিমাণ বোঝায় যে পাঠক বুঝে নিন মামলা কদ্দূর এগিয়েছিল!

সেই মামলার কি হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু আমরা কোয়ান্টাম শব্দটা ব্যবহার করার গামলাতে জল ভালোই ঘোলা করে রেখেছি! বস্তুতঃ,  কোয়ান্টাম লিপ বা জাম্প অর্থাত্ বাংলায় যাকে লাফ বলে,  তার দুরকম অর্থ বৈজ্ঞানিক পত্রিকাগুলোয় ব্যবহার হয়। প্রথমে বোঝায় ইলেকট্রনের এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে লাফ দেয়া, দুইনম্বর হল কোন বিষয়ে অতি সামান্য অগ্রগতি। তাই সাধারণ পাঠককে সাবধান হতে হবে কোন প্রসঙ্গে কিভাবে শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে।

দ্বিতীয় সমস্যা, দেখা নিয়ে, আজ্ঞে হ্যাঁ, কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে দেখা নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। কালজয়ী গায়ক তো গেয়েই খালাস, একপলকের একটু দেখা,  আরো একটু বেশী হলে ক্ষতি কী? হ্যাঁ মশাই ক্ষতি আছে,  ভালো করে নজর করতে গেলে আপনার বিষনজর পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্বেস না হয় আগের পর্বটা আরেকবার পড়ুন, বেড়াল মরতেও পারে বাঁচতেও পারে,  তবে আপনি জানবেন কখন,  না বাক্স খোলার পরে! তার মানে কি এই হলো না যে আপনি দেখলেন বলে জানলেন বেড়াল মরা না জ্যান্ত! তার মানে ঘুরিয়ে বললে আপনার দেখা, বা না দেখা, বেড়ালের বাঁচা মরার তথ্যটাকে প্রভাবিত করছে। এটাকে আরো অন্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।  তার মানে আপনি আজ এইমাত্র আকাশে দেখেন নি চাঁদটাকে,  অতএব চাঁদ থাকতেও পারে,  নাও পারে! আহা,  অধৈর্য্য হন কেন, আপনি কোন ছাড়, ইতিহাস বলে, আইনস্টাইনের অব্দি এইসব শুনে শেষদিনতক গলাবুকজ্বালা করতো! আপনি বাক্স খুলে বেড়াল পরীক্ষা করছেন কি না দেখার জন্য রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে আপনার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে! সে যদি না দেখে তো আপনি বেড়ালের বাঁচা মরার তথ্য জানতেও পারেন, নাও পারেন! আজ্ঞে হ্যাঁ কত্তা,  এখানে আপনার উপর পরীক্ষা করছে লোকটা।  সেই লোকটার উপর কেউ স্যাটেলাইট থেকে নজরদারি চালাতেই পারে,  আপনাকে দেখছে কি না সে। এমনিভাবে দেখার কথা ভাবতে থাকলে একসময় সৌরজগত,  ছায়াপথ পেরিয়ে ব্রম্ভান্ড অতিক্রম করে যাবেন। ব্রম্ভান্ড মানে হল কি না ইউনিভার্স, মানে একটা গুচ্ছ বা বিশ্ব, তার বাইরে থেকে যদি কেউ নজর রাখে, তবে? তার মানে কি ইউনিভার্স একপিস নয়, আসলে অনেকগুলো? এইভাবে অনেক অনেক ঘোরতর প্যাঁচালো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় বটে, কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষের যত নজর গিয়ে পড়ে ওই মিস্টিক অনুসিদ্ধান্তটির উপর, যে একের বেশী বিশ্ব মানে মাল্টিভার্স থাকার অর্থ মাল টি ভরসা করছে তার বাইরে থাকা এক শক্তির উপরে,  যে সব দেখছে,  তার নাম ভগবান।

ব্যাস, আর যায় কোথা! বিজ্ঞান আর ধর্মকে মেলানো গেছে বলে ধর্মব্যবসায়ীরা মাঠে নেমে পড়লো।  বলা হল,  আপনার দেখা,  অর্থাত্ কিনা আপনার চেতনা কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের ফলশ্রুতি, (অবশ্য একদিক দিয়ে দেখতে গেলে চেতনা, বা সিগন্যালিং ব্যবস্থা বা কোষ ইত্যাদি তো মূলে সেই পারমাণবিক কোয়ান্টামীয় ব্যাপারে গিয়ে মেলে,  কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা সেসব বুঝলে বা বোঝালে তো!) তার মানে “ইদিকে আসুন, চেতনার জাগরণ ঘটান আমাদের আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম হিলিং দিয়ে” (বিতর্কিত ডাক্তার দীপক চোপড়া দ্রষ্টব্য)! বিজ্ঞানী বোঝাতে গেলেন এক, মিডিয়া প্রচার করলো আরেক! কোয়ান্টাম হিলিং বা রোগমুক্তি একটি সার্টিফায়েড ছদ্মবিজ্ঞান, সাধারণ পাঠককে তার ফাঁদ থেকে মুক্ত করার দায় সেই নির্মোহ বিজ্ঞান সাংবাদিকের। এরকম আরেকটি শব্দবন্ধ শুনে থাকতে পারেন,  কোয়ান্টাম চেতনা বা কনশাসনেস,  বাস্তবে যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কোন শাঁস নেই! মাঝে এরকম একটি ধারণা বাজারে চলেছিল যে জগত্টা নাকি উন্নতশ্রেণীর ভিনগ্রহী প্রাণীদের দ্বারা গবেষণামূলক পরীক্ষার জন্য তৈরী সিম্যুলেশন বা মডেল ছাড়া আর কিছু নয়। অঙ্কটঙ্ক কষে এ ধারণা যে ভুল তা প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

হয়তো আমার আপনার চেতনার রঙেই পান্না হল সবুজ, কিন্তু সে কেবলই কবির কথার খেলা, কোয়ান্টাম চেতনার আসল স্বরূপ আয়ত্ত করতে মানবের এখনো অনেক সময় লাগবে। আর যাই হোক তা দিয়ে এই মুহূর্তে আপনার দেহের ক্যানসার সারানো যায় না!

কি বললেন,  মনের ক্যানসার?

********

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্যাঁচালো কান্ড

প্যাঁচালো কান্ড

(স্বীকারোক্তিঃ পদার্থবিদ তথা দার্শনিক আরউইন শ্রোয়েডিংগারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য মাত্র, পদার্থবিদ্যার গুরুগম্ভীর পুঙ্খনাপুঙ্খ ব্যাখ্যার আঘাত বাঁচিয়ে কেবল উপরস্তরের ভাসা ভাসা মাখনটুকু পরিবেশিত হল।)

কল্পনা কয়, গল্প না হয় একটুও নেই সত্যিটাতে,
কিন্তু ভেবে বলতো দেখি, এমন আসে কল্পনাতে?
অবস্থারা ঠ্যাং জড়িয়ে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে,
এম্নিতরো “রসিকতা” কোয়ান্টামই করতে পারে!
ঢাকনা খুলে যেই দেখেছিস তোর হুলোটা জ্যান্ত বেঁচে,
কেমন করে জানতে পেরে দূরের বেড়াল ঠিক টেঁসেচে!
তুই ভেবেছিস, গাঁজাখুরি! খেয়াল খুশীর তত্ত্ব যতো!!
তা নয়, তা নয়, অ্যাপ্লিকেশান, দেখতে পাবি সময় মতো।
ধীরে ধীরে পন্ডিতেরা পাকাচ্ছে হাত এ বিদ্যাতে,
ক্রিপ্টোগ্রাফি, কম্পিউটিং, ঋদ্ধ হয়ে উঠবে জাতে।
তখন তোরা মান্থলি কাটিস, বসবি চড়ে--নিমেষ-যানে,
সময় ছাড়াই পৌঁছে যাবি, কোয়ান্টেলিপোর্টেশানে।

একথা সকলেই অল্পবিস্তর জানেন যে “কোয়ান্টামম্ ক্লাসিকালম্ নৈব তুল্যং কদাচন”। সেই কোয়ান্টামীয় অদ্ভূতুড়ে কান্ডের সম্ভাব্য সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হল ‘শ্রোডিংগারের বেড়াল’ নামক চিন্তা-পরীক্ষা (Thought-experiment)। একজন পদার্থবিদ, যিনি বেড়ালদের খুব একটা বেশি পছন্দ করেন না, তিনি একটা বাক্সের মধ্যে একখানা বেড়াল রেখে দিলেন। বেড়ালটার সঙ্গী হিসেবে বাক্সে রাখা আছে একপিস মারাত্মক বোমা, আজ্ঞে হ্যাঁ, কিংবা কোন প্রাণঘাতী জিনিস ধরুন, যেটা ফাটার চান্স ফিফটি ফিফটি, বাক্স বন্ধ থাকা অবস্থায়। এর মানে হল এই যে, বাক্স যতক্ষণ না খুলছি, ততক্ষণ জানার কোন উপায় নেই যে বোমাটা ফেটেছে না ফাটে নি! অর্থাত্, বেড়ালটা পটল তুলেছে না কি তোলে নি। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার ভাষায় আমরা বলতে পারি, আমাদের বাক্স খুলে দেখার আগে, বেড়ালটা ছিল জ্যান্ত আর মরা এই দুই অবস্থার মিক্চার! দুই অবস্থা যেন প্যাঁচ মেরে একটা আরেকটায় ঢুকে আছে। ঠিক এরকমই ঘটে কোয়ান্টাম দুনিয়াতে। যেমন পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে পাক খাওয়া ইলেকট্রনের কথাই ধরা যাক। আসলে কিন্তু ইলেকট্রনেরা ওরকম পাক টাক কিছুই খাচ্ছে না, তারা আসলে ভেতরের ফাঁকা জায়গাটার সবটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঘের মত। সবটা একসাথে, একই সময়ে। কিছু জায়গায় থাকার সম্ভাবনা বেশি, কিছু জায়গায় কম। কোন এক মুহূর্তে সেটা কোনখানে আছে সেটা জানতে হলে আগে আমাদের পরমাণু নামক বাক্সটার ঢাকনা খুলে বিশেষ কোন যন্ত্র দিয়ে তার অবস্থান “মাপতে” হবে! (যদিও মাপামাপির ব্যাপারটা ডেঞ্জারাস এসব ছোট জিনিসের ক্ষেত্রে, কারণ এরা হল আপিসের কর্মঠ কর্মীদের মতো, তাঁদের ভালোমানুষী টেস্ট করতে বারবার যদি আমবাঙালিদের মত তাঁদের “কাঠি” করেন, তাঁদের স্বভাব যেমন পরিবর্তন হতে বাধ্য, তেমনি কোয়ান্টাম দুনিয়ায় একটা ধর্ম ঠিকঠাক করে মাপতে গেলে অন্য ধর্মটা বেগড়বাঁই করে বসে!) ঠিক ওই বেড়ালের পরীক্ষার মত, অবস্থান মাপার আগে অব্দি ইলেকট্রন সর্বত্র বিরাজ করতে পারে, জ্যান্ত ও মরার মিক্চারের মত।

এই চিন্তা-পরীক্ষা থেকেই কোয়ান্টাম এনট্যাংগলমেন্ট (entanglement) বা কোয়ান্টাম প্যাঁচ ধারণার উত্পত্তি। ধরা যাক একটা বাক্সে একটা বেড়ালের বদলে দুটো বাক্সে দুখানা বেড়াল আছে। আগের মত ফিফটি ফিফটি ফাটার চান্সওয়ালা বোমা রেখে পরীক্ষাটা রিপিট করা হল। সবাই বুঝতেই পারছেন যে এবার চারজোড়া অবস্থার প্যাঁচ তৈরী হতে পারে:

প্রথমতঃ দুটো বেড়ালই জ্যান্ত
দ্বিতীয়তঃ দুটো বেড়ালই মৃত
তৃতীয়তঃ ডানদিকেরটা জ্যান্ত, বাঁ দিকেরটা মৃত
চতুর্থতঃ ডানদিকেরটা মৃত, বাঁ দিকেরটা জ্যান্ত

এইবার ধরুন কোনভাবে প্রথম আর দ্বিতীয় সম্ভাবনাকে বাদ দিতে পারা গেল। বাকি যে দুজোড়া প্যাঁচ থাকলো পড়ে, তারা হল একটায় মরা হলে অন্যটা জ্যান্ত আর একটায় জ্যান্ত তো অন্যটায় মরা! কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার ভাষা অনুযায়ী বেড়ালদুটোর অবস্থা হয়ে গেছে এনট্যাংগলড্। যদিও সমস্যা হল, কোন বেড়ালটা বাঁচবে আর কোনটা মরবে, তা আগে থেকে জানার কোন উপায় নেই। কিন্তু এটা ধ্রুব সত্য যে একটা বাঁচলে অন্যটা মরবে। ঠিক এইখানে পরীক্ষাটা হেড টেলের টসিং থেকে আলাদা, কারণ সেক্ষেত্রে আপনি আগে থেকেই জানেন মুদ্রার কোনদিকটা হেড, কোনদিকটা টেল। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে ডানদিকের বাক্সটাকে আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতে আর বাঁদিকের বাক্সটাকে ব্রম্ভান্ডের সর্বশেষ গ্যালাক্সিতে নিয়ে গিয়ে ঢাকনা খুললেও একই ফলাফল বেরবে, অর্থাত্, একটায় জ্যান্ত হলে অন্যটায় মরা বেড়াল দেখতে পাবো। বেড়াল দুটোর মত এই আচরণ কোয়ান্টাম দুনিয়ায় ইলেকট্রন কিংবা ফোটনের ক্ষেত্রে ভালোমত পরীক্ষাসমেত প্রমাণিত হয়েছে। তবে একটা এনট্যাংগলড্ বেড়াল ওরফে অবপারমাণবিক কণা কিভাবে অন্যটার অবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানতে পারে তত্ক্ষণাত্, সেটার মৌলিক কারণ খোঁজার চেষ্টা এখনো চলছে। অবশ্য এখনই এরকম হলফ করে বলা যায় না, যে পুঁটির শাড়ীতে ফলস্ পার বসানো হয় নি, টাকা দাও, এরকম তথ্য পুঁটির মা আলোর থেকেও বেশী বেগে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ থেকে অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথে পুঁটির বাবাকে পাঠাতে পারবে কি না! পদার্থবিদ মিচিও কাকু মনে করেন সেরকম না হওয়ার চান্স বেশী। সে যাই হোক তথ্য আদানপ্রদানের এরকম অদ্ভূত তত্ত্ব শুনলেই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের “জুতা আবিষ্কার” কবিতার সেই চামার কুলপতি আর হবুচন্দ্র রাজার মন্ত্রী গোবুচন্দ্রের কথা, পরস্পরের মন কি সত্যি এরকম এনট্যাংগলড্ ছিল নাকি কেবল ফিচলেমো:
“আমারো ছিল মনে,
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।”

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়