Sunday 29 April 2018

পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

   পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

                              এক.

              "আমার মনের পরমাণুর সনে,
              মিলন হবে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে!"

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ্ ক্যাং কুয়েন নি এর পরীক্ষায়, সূঁচের ডগার থেকেও অনেক ছোটো হাওয়া বাতাসহীন একটা জায়গায়, আলো দিয়ে আটকানো একপিস্ সোডিয়াম পরমাণু বসে বসে এই ভাবছিলো! মিলেছিলো চোখের পলকেই, তবে মনের মতো পরমাণু পায় নি সোডিয়াম। সোডিয়ামের যেমনি ক্ষারালো স্বভাব, তেমনি আরেকটা ক্ষার ধাতুর পরমাণু, নাম সিজিয়াম, আরেকটা ওমনি জায়গায় আলো দিয়ে আটকানো ছিলো আর অপেক্ষা করছিলো ফোটন নামে এক পুলিশের। এখন সোডিয়াম যদি হালকা ফুলকো মেজাজের বউমা হয়, সিজিয়াম তবে একটু ভারিক্কি গোছের শাশুড়ি। স্বাভাবিক অবস্থায় এদের মধ্যে যে খুব বনিবনা হবে না, সেটা টিভির সিরিয়াল-বিজ্ঞানীরা ভালো জানেন! কিন্তু ফোটন পুলিশের সিগন্যাল পেয়ে মিললো তারা, এবং তৈরী করলো একটাই অণু, কিছুটা খ্যাপাটে অবস্থায় যদিও, যার সাক্ষী 12 ই এপ্রিল 2018 সালের সায়েন্স পত্রিকার একটি রিপোর্ট ( doi: 10.1126/science.aar7797)।

ক্যাডবেরির বিজ্ঞাপনে শাশুড়ী বউমার সেই সাত সমুন্দর নাচের কথা মনে আছে নিশ্চয়!

একটা পরমাণু আরেকটা পরমাণুর সঙ্গে মিশে একটাই অণু জন্ম দিলো -- এ যেন ইস্কুলের বিজ্ঞান বইতে লেখা A + B = C এইরকম ব্যাপার! বাস্তবে রাসায়নিক বিক্রিয়া আগে কখনো এতো সরল হয় নি। বিক্রিয়া মানেই ট্রিলিয়ন বিলিয়ন পরমাণু কৌরব পাণ্ডবদের মতো আক্রমণ বলে একে অন্যের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া! “তারপর কী হইলো জানে শ্যামলাল” মানে রসায়নবিদ্। সেখানে বেশীরভাগ সময় প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় অণু পরমাণু বেশী তৈরী হয়। এরকম আলোর চিমটে করে দুটো পরমাণু তুলে ধরে আলো ফেলে ওদের মিশিয়ে দিয়ে নূতন অণু তৈরী, এটা মানুষের পক্ষে একটা অকল্পনীয় ব্যাপার বটে!

চিমটে কী করে আলোর হয়??

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Sunday 22 April 2018

ফোটনের ফাঁদে

             লেজারের ঝর্ণাধারায়

বিলম্বিত শুভ নববর্ষ!

আলো বাড়ছে, গরম বাড়ছে। বৈশাখ শুরু হলো। সূর্যের আলো মাথা গরম করে দিচ্ছে আমাদের। আলো আর তাপ যেন দুই বন্ধু। যেখানে আলো পড়ে সেখান গরম হতে শুরু করে। আবার কখনো কখনো তাপ দিতে দিতে জিনিস জ্বলে গিয়ে আলো বিকিরণ করতে শুরু করে। আলো আবার অনেকরকম, সব আলোকে মানুষ চোখে দেখতে পায় না। তবে যন্ত্রে ধরতে পারে। সব আলোই একরকমের শক্তি। জানলে আশ্চর্য লাগবে, তাপও একরকমের আলো। আমাদের দেহ থেকে এই বেরোনো তাপ বা আলো কুকুর বেড়ালরা অন্ধকারে দেখতে পায়।

আলোর শক্তি দিয়ে সাধারণতঃ জিনিস বা জিনিসের কণাগুলোকে খ্যাপানোই হয়। আলো ভূত বা পদার্থ নয় বরং বলা যায় অদ্ভূত। কখনো আলোকে ভরহীন কণার স্রোত বলে কল্পনা করা যায়। কখনো বলা হয় আলোর শক্তি ঢেউ হয়ে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। ঢেউ বড়ো ছোট হতে পারে। ঢেউগুলো যত কাছাকাছি থাকে শক্তি তত বেশী হয়। আর দূরে দূরে থাকলে শক্তি কম। ঘনঘন আসা ঢেউ এর ধাক্কা কেমন তা সমুদ্রে স্নান করা লোক মাত্রেই জানবেন। আলোর সব ঢেউ আবার একতল দিয়ে চলে না। কেউ উপরে কেউ নীচে বিভিন্ন বেগে ছোটে। সাধারণ আলোতে এইরকম ঢেউ থাকে। একই মাপের একই বেগে চলা ঢেউ একরঙের আলো তৈরী করে, যদিও তারা একই তলে থাকে না। সেইজন্য এইরকম আলো ছড়িয়ে পড়ে বেশীদূর যেতে পারে না। যদি এইরকম আলোর ঢেউকে জোর করে একইতলে একসাথে চালানো যায় তবে সেটা যে শক্তিশালী হবে সন্দেহ নেই। একতা আছে বলেই ওরা অনেকদূর যেতে পারে। এরকম আলোর নাম লেজার (Light Amplified Stimulated Emission of Radiation, LASER) রশ্মি, মাত্র 0.001 মিলিমিটার চওড়া।

গোয়েন্দা গল্পে এবং সিনেমায় লেজার আলোর ব্যবহার দেখলে তাকে বেশ মারকুটে বলেই মনে হয়। জেমস্ বন্ড লেজার দিয়ে লোহার বন্ধ দরজা কেটে ফেললেন। নায়িকার পোষা বেড়ালের লেজ কেটে দিলো লেজার। লেজার দিয়ে সুরক্ষিত ব্যাঙ্কের ভল্ট। লেজার বোমা প্লেন থেকে ছুটে এসে ধ্বংস করলো বাড়ী। বাস্তবে প্রচুর শক্তিশালী লেজার দিয়ে ঝালাই পর্যন্ত করা যায়। লেজার মানেই সবসময় জিনিস পুড়িয়ে দেবে এমন কিন্তু নয়। শক্তিশালী লেজার পদার্থকে ঠান্ডাও করে দিতে পারে।
ঠিক কতটা ঠান্ডা জানতে গেলে আগে জানতে হবে ঠান্ডা কী?

ঠান্ডা মানে তাপের অভাব। তাপ কিরকম?

জিনিস যা দিয়ে তৈরী সেইসব অণুপরমাণু কোনো সময় স্থির নেই, জিনিস যতই স্থির হোকনা কেন। ভেতর ভেতর এই যে ছোটাছুটি চলছে, ওটাই বাইরে তাপ হিসেবে ধরা দেয়। ছোটাছুটি যত বেশী, তাপের মাত্রা তত বেশী। সূর্যের পিঠের তাপমাত্রা 6000 কেলভিন, লোহা  1800 কেলভিনে গলে। 373 কেলভিনে জল ফোটে, 303 কেলভিন আমাদের ঘরের উষ্ণতা। জল বরফ হয় 273 কেলভিনে। 200 কেলভিনে কার্বন ডাই অক্সাইড বরফ হয়, 50 কেলভিন নামার আগে বাতাস তরল হয়ে যায়। মহাকাশের গড় তাপমাত্রা 3 কেলভিন।

প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাপমাত্রা 0 কেলভিনের কাছে আরো কাছে নিয়ে যেতে। লেজার রশ্মির সাহায্যে 0.000001 কেলভিন থেকে 0.000000001 কেলভিন তাপমাত্রার সৃষ্টি করা যায়। ক্ষার ধাতুর গ্যাসগুলো এই কাজের জন্য সবথেকে উপযোগী। লিথিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, রুবিডিয়াম, সিজিয়াম, ফ্রান্সিয়াম -- এই সাতটা মৌল হলো রসায়নের ভাষায় ক্ষার ধাতু। ফ্রান্সিয়াম তেজস্ক্রিয়, তাই ওকে না ঘাটানোই ভালো। তা বাদে বাকি ধাতুগুলো গ্যাসীয় অবস্থায় নিয়ে গিয়ে দেখা যায় পরমাণু গুলো নিজেদের মতো স্বাধীন ভাবে ছোটাছুটি করছে। সোজা নিয়ম হলো, গ্যাসের তাপমাত্রা কমাতে গেলে পরমাণুদের ছোটাছুটি থামাতে হবে। তার জন্য ধাতব গ্যাসটাকে এমন একটা কাচের ঘরে আটকাতে হবে যেটা নিঁখুতভাবে বায়ুশূন্য।

ধরা যাক ওই ঘরে সোডিয়াম বাষ্প ভর্তি। ভেতরের চাপ অনেক অনেক কম। তাই সোডিয়ামের নিস্তড়িত্ পরমাণু গুলো একটা আরেকটার থেকে অনেক দূরে দূরে নিজের মতো করে ছুটছে। আমরা ধরলাম একটা পরমাণুকে কোন দিব্যচোখ দিয়ে। দেখছি সেটা ডানদিকে ছুটছে। আমি ডান দিক থেকে কণাটার ঠিক মুখোমুখি একটা লেজার রশ্মি চালিয়ে দিলাম। লেজারটার শক্তি এমন যে তা পরমাণু শোষণ করতে পারে না।

পরমাণু খুব নিয়মনিষ্ঠ কণা। যে কোন শক্তি মাত্রা পেলেই সে শোষণ করবে বা খাবে এমনটা নয়। পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকে ইলেকট্রন। বাইরে থেকে শক্তি পেলে ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে বেশী শক্তির কক্ষে চলে আসে। উত্তেজিত হবার জন্য যতটুকু শক্তি প্রয়োজন ততটুকুই পরমাণু নেবে। প্রতিটা পরমাণুতে হালকাভাবে আটকানো ইলেকট্রন এক বা একের বেশী আছে। সেইমতো প্রতিটি পরমাণু উত্তেজিত হতে একটা  ন্যূনতম শক্তি লাগে। এরথেকে একটু খানি কম শক্তির আলো পরমাণুতে পড়লেও পরমাণু সে আলোর ফোটনকণা খায় না। তবে ফোটনের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে ওর বেগ কমে। কিন্তু পরমাণুটা এখনো ওই ডানদিকে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলো তার সাপেক্ষে লেজারের ফোটনের শক্তি যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ডানদিক থেকে মুখোমুখি ছুটে আসা ফোটনগুলো যেন হর্ন বাজানো (শক্তি) অ্যাম্বুলেন্স, যত কাছে যাচ্ছে হর্ন বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। পরমাণু ভাবে, এ ডপলার সাহেবের কৃপা। ডপলার এফেক্ট। ফোটনের শক্তি বাড়ছে মানে পরমাণু একসময় তাকে খেতে পারে, যেটা আগে হচ্ছিলো না। পরমাণু ছোটাছুটি করার আগ্রহ হারালো, ডানদিকে গেলেই খাবার মতো ফোটন পাওয়া যায় যখন তখন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে কী লাভ! এদিকে উল্টোদিক থেকে আসা ফোটন গিললে পরমাণুর বেগ যে কমবে সেটা ফুটবলার মাত্রই বোঝেন। বেশী জোরে নিজে ছুটলে বলটা ফসকাবে। কাজেই পরমাণুর বেগ কমতে হলো। পরমাণুর অস্থিরতা যেন কমছে! আবার সঠিক শক্তির ফোটন গিললে পরমাণুর ইলেকট্রন উত্তেজিত হবেই। বেশীক্ষণ এরকম অবস্থায় না থেকে পরমাণু সেই ফোটন ছেড়ে স্বাভাবিক হতে চাইবে। ফোটন বেরোনোর সময় পরমাণু উল্টোদিকে ধাক্কা খায়, ঠিক গুলি বেরোলে বন্দুক যেমন সরে আসে। এ সময় পরমাণুর অস্থির হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ফোটন বেরনোর দিকের যেহেতু কোনো ঠিক নেই, তাই সবদিকের সম্ভাব্য ধাক্কা একে অন্যকে কাটাকুটি করে দেয়। পরমাণুর অস্থিরতা বাড়তে দেয় না।

কিন্তু পরমাণুটা যদি খালি ডান দিকে না চলে? তবে উপায়?

বেশ, তাহলে বাঁদিক ডানদিক সামনে পেছনে উপরে নীচে x y z তিনটে অক্ষ বরাবর লেজার রশ্মি দিয়ে আক্রমণ শানাও। পরমাণু আর ছোটাছুটি করতে পারবে না। আলোকীয় ফাঁদের পাল্লায় পড়ে পরমাণু প্রায় স্থির হয়ে পড়েছে এখন। তাপমাত্রা নামছে হু হু করে। লেজার দিয়ে মাইক্রোকেলভিন তাপমাত্রায় শীতলীকরণের এই পদ্ধতি আবিষ্কারকে 1997 সালে মানুষ সম্মান জানিয়েছে পদার্থবিদ্যায় নোবেল দিয়ে। কেন, সে গল্পের জন্য তো পুরো নতুন বছর রইলোই।

এক কেলভিনের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত ঠান্ডা করা পরমাণুপুঞ্জ আটকে আছে আলো দিয়ে বানানো এক চিটেগুড়ে, লেজারের ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে শীতল করা কী একেই বলে?

©শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

পরমাণুর কথা

পরমাণুর ভালো বাসা

পরমাণুর ভিতরের অধিকাংশ স্থানই ফাঁকা, আর এর ঠিক মধ্যিখানে দলা পাকিয়ে আছে নিউক্লিয়াস। তাকে ঘিরে আছে ইলেকট্রনের মেঘ। এ দুয়ের মাঝে অনেকটা জায়গাই স্রেফ্ শূন্য।

দুটো পরমাণু একে অন্যকে কতটা ভালোবাসলে একটার ভেতরে আরেকটা সেঁধিয়ে যেতে পারে? নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকলে না হয় হলো রাসায়নিক বন্ধন, 'অন্যায়' করে হলে আয়নীয়, আর 'সম্ ঝোতা' করে হলে সমযোজী, কিন্তু ওই অব্দিই। বেশী কাছে এগোলে ইলেকট্রনের মেঘগুলো একে অন্যকে ঠেলাঠেলি করতে শুরু করবে। ধাতব বন্ধনী অবশ্য একটু উদার। সেখানে ইলেকট্রন মেঘগুলো বড়ো আলগা, নিজেরা হাত ধরাধরি করে ইলেকট্রনের সমুদ্র বানায়, তাতে ভেসে থাকে সেতুবন্ধনের পাথরের মতো ধনাত্মক আয়নগুলো। এসবই সাধারণ চাপ আর তাপমাত্রার ধারণা।

একটু অসাধারণ তাপমাত্রায় আসা যাক। বজ্রপাতের সময় বাতাসের তাপমাত্রা হয়ে যায় প্রায় 28000 কেলভিন। ওই ভয়ানক গরমে বাতাসের অণু পরমাণু থেকে ইলেকট্রন খুলে বেরিয়ে আসে, পরমাণু হয়ে যায় আয়ন, বাতাস হয়ে যায় আয়নিত। এমনি বাতাসের থেকে এর আচরণ আলাদা। এটা হলো পদার্থের চার নম্বর অবস্থা, প্লাজমা।

তাপমাত্রা কমালে? পরম শূন্য বা জিরো কেলভিনের  কাছে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। 1995 সালে রুবিডিয়াম নামে এক ধাতুকে গ্যাসীয় অবস্থায় নিয়ে গিয়ে তার উষ্ণতা 0.00000017 কেলভিন পর্যন্ত নামানো হয়েছিলো। এতো কম তাপমাত্রায় পরমাণুগুলো বোসন কণার মতো আচরণ করে। বোসন কণা অনেকটা শেয়ালদের মতো। সব শেয়ালের যেমন এক রা, তেমনি একগাদা বোসনের সবাই একই শক্তিমাত্রায় থাকতে পারে, একই কোয়ান্টামীয় বাসা শেয়ার করতে পারে। মোট কথা একেবারে গলায় গলায় ভাব! যদি ওদের সাথে প্রতিদিন বাজার করতে গিয়ে দেখা হতো, দেখতাম বাবা মা মাসী মেসো, পিসী, পিসে, মামা কাকা সবাই একরকম দেখতে, কারো থেকে কাউকে আলাদা করে চেনার জো নেই। পরমাণু যতক্ষণ সাধারণ ভাবে ছিলো, ততক্ষণ এমনটি হয়নি। জিরো কেলভিনের ঠ্যালায় পড়ে সবাই যেন অনেক দেহ, এক প্রাণ। 'একই সূত্রে বাঁধিয়াছে সহস্র জীবন'। দেখা গেলো, প্রায় 2000 খানা রুবিডিয়াম পরমাণু এই অবস্থায় ভালোবাসাবাসি করে থাকতে পারে। এরা আর সাধারণ আলাদা আলাদা পরমাণু নেই, সৃষ্টি হয়ে গেছে বোসনীয় মহাপরমাণু! নিঃসন্দেহে এটাও পদার্থের আরেকটা নূতন অবস্থা। একে বলা হয় 'বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা', পদার্থের পঞ্চম অবস্থা।

কিন্তু এখনো পরমাণুরা একে অন্যকে এতোটাও ভালোবাসতে পারে নি যে একে অন্যের ভিতরে হৃদয়ে ঢুকে যাবে! স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে, তাহলে একটা পরমাণুকে আকারে অস্বাভাবিক বড়ো হতে হবে। তবে ওর মধ্যে আরেকটা পরমাণু সেঁধোতে পারবে। কিন্তু তাইবা হবে কি করে? পরমাণুদের পাম্প দিয়ে ফোলানো যায়? যায় বটে, তবে শক্তি পাম্প করতে হবে। শক্তি দিয়ে পরমাণুকে খেপিয়ে দিলে ইলেকট্রনের মেঘেরা ছটফট করতে করতে নিউক্লিয়াস থেকে বেশ দূরে সরতে পারে। পরমাণুর সীমানা তো তদ্দুরই যদ্দুর ইলেকট্রন মেঘ বিস্তৃত। খ্যাপা পরমাণুতে ইলেকট্রনমেঘ যত নিউক্লিয়াস থেকে দূরে ছড়িয়ে যাবে ততই পরমাণুর আকার বাড়বে। বেশী খেপালে আবার ইলেকট্রন বিরক্ত হয়ে পাকাপাকি ভাবে পালাবে। তাই সাবধান! পরমাণু ফুলুক, কিন্তু যেন না ফাটে। ফাটলেই আয়ন হয়ে যাবে! পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ইলেকট্রনগুলোকে নিউক্লিয়াস থেকে সরালে সবচাইতে বেশী প্রায় কয়েকশো ন্যানোমিটার (0.000000001 মিটার) ফাঁকা জায়গা মেলে। তার মধ্যে প্রায় 500 খানা সবচেয়ে ছোটো যে পরমাণু,হাইড্রোজেন, তারা ধরে যাবে! এইরকম অস্বাভাবিক ফুলকো পরমাণুকে বলে রিডবার্গ পরমাণু। রিডবার্গ পরমাণুদের আচার আচরণ স্বাভাবিক পরমাণুদের মতো যে হবে না তা বলাই বাহুল্য! এইরকম পরমাণুদের তৈরী করার সবচেয়ে আধুনিক উপায় হলো নির্দিষ্ট শক্তির লেজার রশ্মি ছোঁড়া। লেজারের শক্তি থেকে পরমাণু শক্তি নিয়ে খেপে ফুলে উঠবে। জন্ম হবে রিডবার্গ পরমাণুর।

আমেরিকার টেক্সাসে, রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু অন্যরকম ভাবে রিডবার্গ পরমাণু তৈরী করা হলো। 2018 সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বিজ্ঞানীরা জানালেন তারা কী কী করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথমে স্ট্রনসিয়াম ধাতুর পরমাণুদের জিরো কেলভিনের খুব কাছাকাছি বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থায় নিয়ে আসা হলো। অর্থাত্ পরমাণু গুলো এখন আর আলাদা আলাদা পরমাণু হিসেবে কাজ করছে না,
ভালোবাসায় তারা মাখোমাখো হয়ে একটাই মহাপরমাণু বা সুপারঅ্যাটম হয়ে গেছে। খুব কাছাকাছি ঘন হয়ে বসেছে তারা। এমনি সময় নির্দিষ্ট শক্তির লেজার রশ্মি ফায়ার করা হলো। মহাপরমাণুর জোটের ভিতরে ধরাযাক একটি পরমাণু রিডবার্গ পরমাণু হয়ে ফুলতে লাগলো। মোটা বন্ধুর ঘামের গন্ধে বাকিদের পালানোর কথা! কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছে যে, যাবে কোথায়! বর্ণালীবিক্ষণ যন্ত্র জানালো বিজ্ঞানীদের, ফুলে ওঠা রিডবার্গ পরমাণুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে অন্তত 170 টার মতো স্ট্রনসিয়ামের পরমাণু, বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা থেকে! এই পরিস্থিতি যে হতে পারে তা কম্পিউটার-নির্ভর তাত্ত্বিক গণনায় আগেই জানা গেছিলো 2016 সালে। এখন প্রমাণও পাওয়া গেলো।

শেষমেষ তাহলে পরমাণুর পেটেও পরমাণু দলবল নিয়ে ঢুকে পড়লো! এখন তাহলে অবস্থাটা কী? স্বাভাবিকের থেকে বেশী ফোলা একটা পরমাণু, তার মধ্যে একটা নিউক্লিয়াস আছে, আর সেই নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুরছে শুধু ইলেকট্রনগুলো নয়, 170 খানা এমনি পরমাণু! মা পরমাণুর পেটের ছানা পরমাণু গুলোর সাথে একরকম পারমাণবিক বন্ধনীও আছে। এই আনকোরা অদ্ভূত বন্ধনীর নাম দেওয়া হয়েছে 'রিডবার্গ পোলারন'। পদার্থের অবস্থার লিস্টিতে নবতম সংযোজন এই অতিশীতল অবস্থা।

মহামানবেরা অনেক আগেই বলে গেছেন, ভালোবাসায় সব হয়!

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়