Sunday 19 August 2018

ঘোরতর প্যাঁচালো কান্ড (দুই)

ঘোরতর প্যাঁচালো কান্ড (দুই)

ম্যাও সামলানো মোটেই সহজ কাজ নয়, বিশেষতঃ সেটা যদি শ্রোয়েডিংগারের ম্যাও হয়! আর এই শ্রোয়েডিংগারের ম্যাও মানে বেড়ালের চক্করে পড়ে বাঘা বাঘা পদার্থবিদেরই চেতনা চটকে যায় তো কোথায় আমাদের মত ছাপোষা লোক! সেই সময় কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভয়ঙ্কর সব গাণিতিক চিহ্নদের ওপর থেকে নজর সরে যায়, ইচ্ছে করে না বড়ো বড়ো সমীকরণগুলো আর তার বাস্তব তাত্পর্য্যগুলোর দিকে তাকাতে, আর ঠিক তখনই, বিজ্ঞান-বিষয়ক চমকপ্রদ তথ্য সরবরাহকারী সংস্থার উল্টোপাল্টা প্রচারের ফলে, প্রকৃত মানে ভুলে গিয়ে সামান্য কতগুলো করোলারির উপরে বেশি বেশি করে গুরুত্ব আরোপিত হয়। তাতে করে চমত্কার চমত্কার সব তাত্ত্বিক ভবিষ্যদ্বাণী বেরোয়! তার বিষয়ে নানা বিদগ্ধ মুনিদের নানা মত থাকতেই পারে, কিন্তু এই মতামতের বিবাদের মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ছদ্মবিজ্ঞান নামক একরকম ক্ষতিকর বিষয়! কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, বলা বাহুল্য, অজস্রবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এইরকম ছদ্মবিজ্ঞানের বিষাক্ত তীরে। সঙ্গত কারণেই, বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের পক্ষেও জনমানসে গেড়ে বসা এইসব ছদ্মবিজ্ঞানের ম্যাও সামলানো মোটেই সহজ নয়। তখন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী নন, নির্মোহচিত্তে নিরলসভাবে হাতে কলমে গবেষণা করে যাওয়া বিজ্ঞানীর দলই পারেন সেই ম্যাও তাড়াতে। বাস্তবিক তাঁরা কোন বড় বড় তত্ত্ব কাগজে লিখে শুধু দেখান না, তাঁরা বলেন, ‘পরীক্ষা করে আমরা এই পেয়েছি, এবার তুমি বা তোমরা সামলাও কিভাবে থিওরি দিয়ে এর ব্যাখ্যা দেবে বাপু! আমাদের কাজ ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, এবার সেটা তোমাদের পোষালে পোষাক, না পোষালে কেটে পড়ো, কিন্তু ফলাফল ধ্রুব সত্য’। আর এইভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে তত্ত্বের পর তত্ত্ব পরিশোধন করতে করতে, তাতে কোন জিনিয়াসই অবশ্য ভুল কি ঠিক প্রমাণিত হয় না, নির্মোহভাবে এগিয়ে চলাই বিজ্ঞানের পথ, আর নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে নিরপেক্ষ ভাবে বৈজ্ঞানিক বিষয়ের বর্তমান পরিস্থিতি প্রচার করাই হল বিজ্ঞান সাংবাদিকের ধর্ম, কিভাবে কি এসেছিল, তার পর্যালোচনা করুন বিজ্ঞানের ইতিহাসবেত্তারা, সাংবাদিকের সে দায় নয়, কারণ না হলে আংশিক সত্য পরিবেশন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে! আর সত্য পুরো সামনে না এলেই ছদ্মসত্য সৃষ্টির একশোভাগ সম্ভাবনা।

প্রথম সমস্যা হল সাহিত্যিক সেক্সপিয়ারকে নিয়ে। হোয়াটস ইন এ নেম নয়, হে মনীষী, বলুন হোয়াটস নট ইন এ নেম,  গোলাপকে যে নামে ডাকুন তা গোলাপই থাকবে,  কিন্তু আমাদের কোয়ান্টাম কথাটি এতই রহস্যরোমাঞ্চকর লাগে যে কোথাও ব্যবহার করতে পারলে বেশ গুরুগম্ভীর মনে হয় নিজেকে। এ প্রসঙ্গে একটা কার্টুন মনে পড়ে গেল,  জজসায়েব উকিলকে জিগ্যেস করছেন,  মামলার ব্যাপারে কদ্দূর এগোলেন? এজলাসের আবহাওয়া ভারিক্কি করার জন্য উকিলরা প্রায়ই গুরুগম্ভীর শব্দ ব্যবহার করে থাকেন,  এ ক্ষেত্রে তিনি বললেন, সামগ্রিক দলিল দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে মামলার কোয়ান্টাম অগ্রগতি ঘটেছে। জজসায়েব যৌবনে পেটেন্ট অফিসের উকিল ছিলেন,  ওনাকে একবার এক কোয়ান্টাম বিশারদের আবিষ্কারের পেটেন্ট করানোর কথা বলা হয়েছিল, উনি বোর্ড ভর্তি অদ্ভূত সব চিহ্ন দেখে অজ্ঞান হয়ে ক্লায়েন্ট হাতছাড়া করেন, তাই আজো সেই ভয়ে বা সম্ভ্রমে, বর্তমান উকিলকে কোয়ান্টাম অগ্রগতি নিয়ে খুঁচালেন না। উল্টে নোট নিলেন,  মামলার কোয়ান্টাম অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাস্তবে, কোয়ান্টাম মানে এত স্বল্প পরিমাণ বোঝায় যে পাঠক বুঝে নিন মামলা কদ্দূর এগিয়েছিল!

সেই মামলার কি হয়েছিল জানা নেই, কিন্তু আমরা কোয়ান্টাম শব্দটা ব্যবহার করার গামলাতে জল ভালোই ঘোলা করে রেখেছি! বস্তুতঃ,  কোয়ান্টাম লিপ বা জাম্প অর্থাত্ বাংলায় যাকে লাফ বলে,  তার দুরকম অর্থ বৈজ্ঞানিক পত্রিকাগুলোয় ব্যবহার হয়। প্রথমে বোঝায় ইলেকট্রনের এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে লাফ দেয়া, দুইনম্বর হল কোন বিষয়ে অতি সামান্য অগ্রগতি। তাই সাধারণ পাঠককে সাবধান হতে হবে কোন প্রসঙ্গে কিভাবে শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে।

দ্বিতীয় সমস্যা, দেখা নিয়ে, আজ্ঞে হ্যাঁ, কোয়ান্টাম বিজ্ঞানে দেখা নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। কালজয়ী গায়ক তো গেয়েই খালাস, একপলকের একটু দেখা,  আরো একটু বেশী হলে ক্ষতি কী? হ্যাঁ মশাই ক্ষতি আছে,  ভালো করে নজর করতে গেলে আপনার বিষনজর পরীক্ষার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্বেস না হয় আগের পর্বটা আরেকবার পড়ুন, বেড়াল মরতেও পারে বাঁচতেও পারে,  তবে আপনি জানবেন কখন,  না বাক্স খোলার পরে! তার মানে কি এই হলো না যে আপনি দেখলেন বলে জানলেন বেড়াল মরা না জ্যান্ত! তার মানে ঘুরিয়ে বললে আপনার দেখা, বা না দেখা, বেড়ালের বাঁচা মরার তথ্যটাকে প্রভাবিত করছে। এটাকে আরো অন্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।  তার মানে আপনি আজ এইমাত্র আকাশে দেখেন নি চাঁদটাকে,  অতএব চাঁদ থাকতেও পারে,  নাও পারে! আহা,  অধৈর্য্য হন কেন, আপনি কোন ছাড়, ইতিহাস বলে, আইনস্টাইনের অব্দি এইসব শুনে শেষদিনতক গলাবুকজ্বালা করতো! আপনি বাক্স খুলে বেড়াল পরীক্ষা করছেন কি না দেখার জন্য রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে আপনার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে! সে যদি না দেখে তো আপনি বেড়ালের বাঁচা মরার তথ্য জানতেও পারেন, নাও পারেন! আজ্ঞে হ্যাঁ কত্তা,  এখানে আপনার উপর পরীক্ষা করছে লোকটা।  সেই লোকটার উপর কেউ স্যাটেলাইট থেকে নজরদারি চালাতেই পারে,  আপনাকে দেখছে কি না সে। এমনিভাবে দেখার কথা ভাবতে থাকলে একসময় সৌরজগত,  ছায়াপথ পেরিয়ে ব্রম্ভান্ড অতিক্রম করে যাবেন। ব্রম্ভান্ড মানে হল কি না ইউনিভার্স, মানে একটা গুচ্ছ বা বিশ্ব, তার বাইরে থেকে যদি কেউ নজর রাখে, তবে? তার মানে কি ইউনিভার্স একপিস নয়, আসলে অনেকগুলো? এইভাবে অনেক অনেক ঘোরতর প্যাঁচালো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় বটে, কিন্তু আমাদের মত সাধারণ মানুষের যত নজর গিয়ে পড়ে ওই মিস্টিক অনুসিদ্ধান্তটির উপর, যে একের বেশী বিশ্ব মানে মাল্টিভার্স থাকার অর্থ মাল টি ভরসা করছে তার বাইরে থাকা এক শক্তির উপরে,  যে সব দেখছে,  তার নাম ভগবান।

ব্যাস, আর যায় কোথা! বিজ্ঞান আর ধর্মকে মেলানো গেছে বলে ধর্মব্যবসায়ীরা মাঠে নেমে পড়লো।  বলা হল,  আপনার দেখা,  অর্থাত্ কিনা আপনার চেতনা কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের ফলশ্রুতি, (অবশ্য একদিক দিয়ে দেখতে গেলে চেতনা, বা সিগন্যালিং ব্যবস্থা বা কোষ ইত্যাদি তো মূলে সেই পারমাণবিক কোয়ান্টামীয় ব্যাপারে গিয়ে মেলে,  কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা সেসব বুঝলে বা বোঝালে তো!) তার মানে “ইদিকে আসুন, চেতনার জাগরণ ঘটান আমাদের আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম হিলিং দিয়ে” (বিতর্কিত ডাক্তার দীপক চোপড়া দ্রষ্টব্য)! বিজ্ঞানী বোঝাতে গেলেন এক, মিডিয়া প্রচার করলো আরেক! কোয়ান্টাম হিলিং বা রোগমুক্তি একটি সার্টিফায়েড ছদ্মবিজ্ঞান, সাধারণ পাঠককে তার ফাঁদ থেকে মুক্ত করার দায় সেই নির্মোহ বিজ্ঞান সাংবাদিকের। এরকম আরেকটি শব্দবন্ধ শুনে থাকতে পারেন,  কোয়ান্টাম চেতনা বা কনশাসনেস,  বাস্তবে যার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কোন শাঁস নেই! মাঝে এরকম একটি ধারণা বাজারে চলেছিল যে জগত্টা নাকি উন্নতশ্রেণীর ভিনগ্রহী প্রাণীদের দ্বারা গবেষণামূলক পরীক্ষার জন্য তৈরী সিম্যুলেশন বা মডেল ছাড়া আর কিছু নয়। অঙ্কটঙ্ক কষে এ ধারণা যে ভুল তা প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

হয়তো আমার আপনার চেতনার রঙেই পান্না হল সবুজ, কিন্তু সে কেবলই কবির কথার খেলা, কোয়ান্টাম চেতনার আসল স্বরূপ আয়ত্ত করতে মানবের এখনো অনেক সময় লাগবে। আর যাই হোক তা দিয়ে এই মুহূর্তে আপনার দেহের ক্যানসার সারানো যায় না!

কি বললেন,  মনের ক্যানসার?

********

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment