Saturday 1 December 2018

পাথর থেকে মানুষ?

পাথর থেকে মানুষ এলো?

আত্মা, পরমাত্মা এবং অতৃপ্ত আত্মা, এই তিন নিয়ে সর্বকালের সর্বদেশের রূপকথা এবং ধর্মের জগত্।
ঠিক কোন সময়টাকে জন্ম বলে সেটা মাথায় না রাখার কারণে মানুষের মনে আত্মা পরমাত্মা ইত্যাদি ধারণার উদ্ভব হয়েছে। মানুষের বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বেরনোর আগে কি জ্যান্ত ছিল না? তারো আগে ভ্রূণটাও ছিল জ্যান্ত। তারো আগে জাইগোট, সেটাও তো মরা জিনিস নয়, তাতেও প্রাণ আছে। আর জাইগোট যে শুক্রাণু আর ডিম্বাণু দিয়ে তৈরী, তাতেও আছে প্রাণ। তারা বেরচ্ছেও জীবিত প্রাণীর শরীর থেকে। তাহলে আমরা জন্মালামটা ঠিক কখন, মরে তো কোনসময়ই ছিলাম না! আমরা গোড়া থেকেই জ্যান্ত, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে না হোক, ক্ষণপদওয়ালা সেই আদিকোষের সময় থেকেই। আমাদের যে এই বাঁচার শক্তিটা, এটা প্রাণ থেকে প্রাণে বয়েই আসছে। জড়ে এ শক্তি নেই, আর চোখের সামনে কোন জড়বস্তুতে প্রাণসঞ্চার হতে দেখিও না। সুতরাং মানুষের মনে প্রাচীনকাল থেকেই ধারণা, প্রাণ একটা শক্তির মত, হতে পারে আত্মা, অথবা অন্য কিছু, যেটা একটা কোন বস্তু নয়, যেটা লৌকিক নয়, অলৌকিক।

বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জটা ঠিক যে এইখানে এই ধারণার সাথে লড়াইয়ে সেটা বললে একটু ভুল হবে, বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ তার নিজের গতকালের ধারণার সাথেও। অবিশ্বাস হলে মনে করিয়ে দিতে হয় সেই পচা জিনিস থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে মশামাছি উদ্ভবের তত্ত্বের কথা। জীবাণু বলে যে একটা জীব আছে, লুই পাস্তুর সেটা আবিষ্কার করে লোককে জানালে, বিজ্ঞান মেনে নিয়েছে রোগের পিছনে জীবাণুর কারসাজির ব্যাপারটা। ভাগ্যিস প্রচলিত ধর্মের মতো গোঁ বা ইগো, কোনোটাই বিজ্ঞানের নেই! সত্যের দিকে যাবার রাস্তাটা ঠিকঠাকভাবে খুঁজে বার করাতেই যেন তার যত আগ্রহ।

কিন্তু এরপরে রাস্তাটা ঠিক কোনদিক থেকে এসেছে তা জানতে গিয়ে বিজ্ঞান অনেকদূর ভেবে ফেলেছে। জড় পদার্থ তো গোড়া থেকেই ছিল এ গ্রহে। সেখান থেকে এলো কি করে জীবন, যাকে প্রাণশক্তি চালায়?

প্রাণ মানে এমন একটা সত্তা যা নিজে থেকে অন্য প্রাণের জন্ম দেয়, নিজেই নিজের জেরক্স অন্ততঃ বানাতে পারার ক্ষমতা তার থাকা চাই। সবথেকে ছোট যে অণুটার এরকম ক্ষমতা আছে মানুষে তার নাম দিয়েছে নিউক্লিক অ্যাসিড। প্রথমদিকের সেই দিনগুলোতে প্রাণহীন পৃথিবী হয়তো ভেবেছিল, জড়বস্তু থেকে কোনভাবে সেই অণুটার কোন অংশ তৈরী করতে পারলেই কেল্লাফতে! কিন্তু ঠিক কিভাবে তখনকার পরিবেশ সেটা বানাতে পারলো, সেটা আজও মানুষে সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারে নি। বিভিন্ন পরীক্ষা থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পাওয়া গেছে এবং যাচ্ছে। জিগস্ পাজল্ সাজানোর মত করে আস্তে আস্তে অবশ্য স্পষ্ট হচ্ছে ছবিটা। সে তালিকায় সম্প্রতি নূতন সংযোজন আটলান্টিক সাগরের তলদেশ খুঁড়ে তুলে আনা তথ্যগুলো।

আটলান্টিক সাগর, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। দুহাজার সাল নাগাদ শুরু করে আজ অব্দি তার তলদেশে মানুষের তৈরী যন্ত্রপাতি অনেক উঁকিঝুঁকি মেরেছে। সমুদ্রের মেঝে তো আমাদের রাঙাকাকিমার গাল কিংবা ভূগোলের স্যারের টাকের মতো মসৃণ নয়, বরং পদিপিসিমার শীতকালের ফাটা গোড়ালির মত! ঐসব ফাটলদের ইংরেজিতে বলে ভেন্ট, ওর থেকে উঠে আসে পৃথিবীর গরম পেটের ভাপ। এরকম ফাটলওলা জায়গাকে ইংরেজিতে বলে হাইড্রোথার্মাল ফিল্ড। সারা পৃথিবীর সাগরের তলায় এরকম অনেক ফিল্ড আছে। বেশীরভাগ এইসব অঞ্চলে ডুবন্ত আগ্নেয়গিরি থাকে। কালো ধোঁয়ার মত গ্যাস বেরিয়ে আসে এইসব ফাটল থেকে, সালফার আর হাইড্রোজেন যার প্রধান উপাদান। চারপাশের জল গরম তো থাকেই, উপরন্তু ভালো মত অ্যাসিডিক হয়ে ওঠে।

আশ্চর্য্যের এই যে, মধ্য-আটলান্টিকের এই জায়গার ফাটলগুলো যেন আর সব ফাটলগুলোর মতো নয়। এরকম একটা আবিষ্কৃত জায়গার নাম মানুষে দিয়েছে লস্ট সিটি হাইড্রোথার্মাল ফিল্ড। এ জায়গা প্রায় দেড় থেকে দু মিলিয়ন বছরের বুড়ো জায়গা! জায়গা বলা হল বটে, তবে জায়গা না বলে জলের তলার এক বিরাট পাহাড়ের মাথা বললে ভুল হবে না। আসলে আটলান্টিক সাগরের যে সবচাইতে নীচু মেঝে, তার থেকে এই জায়গাটা 14000 ফুট উঁচুতে আছে। পাহাড়টার নাম দেয়া হয়েছে আটলান্টিস। সবটাই জলের নীচেকার ব্যাপার! আটলান্টিসের সবচাইতে উঁচু চূড়োটা সাগরের পিঠ থেকে 700 ফুট নীচে! পাহাড়টার 16 কিমি ছড়ানো মাথা, যেটার নাম লস্ট সিটি, সেখানে গোটা তিরিশেক নল আকারের চক বা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের স্তূপ আছে। চিমনির মত এইসব নল থেকে সবসময় মিথেন আর হাইড্রোজেন গ্যাস বেরোচ্ছে। এই অব্দি শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মিথেনের উত্স মরা জীবদেহ। কিন্তু রাসায়নিক বিশ্লেষণ অন্য কথা বলছে!

আটলান্টিস তৈরী হয়েছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম আর বালি দিয়ে তৈরী একরকম আগ্নেয় শিলা দিয়ে। একে বলা হয় পেরিডোটাইট। পেরিডোটাইটের সাথে সাগরের নোনা জল এক রাসায়নিক বিক্রিয়া করে মিথেন আর হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরী করছে। না, কোন জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া নয়, নিখাদ ভৌতরসায়ন! মিথেনের মত হাইড্রোকার্বন তৈরী হবার সাথে সাথে সৃষ্টি হচ্ছে আরো অন্যান্য হাইড্রোকার্বন, অ্যামোনিয়া, এবং বিভিন্ন অ্যামোনিয়া পরবর্তী রাসায়নিক অণু, যেমন ফরমামাইড ইত্যাদি। এগুলো যেহেতু ক্ষারীয় চরিত্রের, তাই আশেপাশের গরম জল অবধারিত ভাবে ভালোমত ক্ষারীয় (pH 9 থেকে 11), যেটা সাগরের তলায় বিরল ঘটনা!

ফ্রান্সের বিজ্ঞানী বেনেডিক্ট মেনেজ আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গো মিলে সাংঘাতিক সব তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন সেইসব জায়গার জলের নমুনা পরীক্ষা করে। লস্ট সিটি অঞ্চলের সাগরের মেঝে ফুটো করেও 170 মিটার নীচে নেমে গেছে তাঁদের যন্ত্র। তুলে এনেছে জলকাদার নমুনা। সেসব দেখেশুনে যন্ত্রে বলছে, সেখানে ট্রিপ্টোফ্যান নামে এক অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে প্রোটিন তৈরী হয় সবাই জানে। ওখানে জনপ্রাণী নেই, তার পচা অংশ নেই, তো ট্রিপ্টোফ্যান এলো কোত্থেকে? ল্যাবরেটরিতে ইন্ডোল নামে একরকমের জৈবযৌগ থেকে ট্রিপ্টোফ্যান তৈরী করা যায় এবং তাতে কোন প্রাণীর সাহায্য লাগে না, তো দেখা যাক ঐ নমুনাতে এরকম ইন্ডোল অণু আছে কি না? যন্ত্র পরীক্ষা করে বলে দিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। ইন্ডোল আছে, এবং কোন জৈব সাহায্য ছাড়াই ট্রিপ্টোফ্যান ঐখানে তৈরী হয়েছে। কোনভাবে পেরিডোটাইট আর নোনা জল মিলেই কার্বন, নাইট্রোজেন আর হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরী ইন্ডোল অণু হয়েছে। ইন্ডোল থেকে ট্রিপ্টোফ্যান তৈরীর রাস্তায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে সম্ভবত স্যাপোনাইট নামে একরকম পাললিক শিলা।

ইন্ডোল আর ট্রিপ্টোফ্যান-এর এই অজৈব উত্পত্তিলাভের পরে ডিএনএ বা আরএনএ-এর অন্যান্য উপাদানগুলোর সৃষ্টি হওয়া আশ্চর্য্যের কিছু নয়। আর তার থেকে জেনেটিক পদার্থের তৈরী হওয়াটাও কল্পসাধ্য কিছু নয়, হতেই পারে। অন্ততঃ পরিবেশ যেমনি ক্ষারীয় এবং বিজারণের উপযোগী তাতে করে জীবনের সাহায্য ছাড়াই নাইট্রোজেন গ্যাস থেকে অ্যামোনিয়া সৃষ্টির থিওরি একদম উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কি করে অ্যামোনিয়া পৃথিবীতে, ঐ পরিবেশে, সাগরের জলে তৈরী হয়েছিল, প্রথমবারের জন্য, তা আজো রহস্যে ঢাকা! 2018 এর নভেম্বরে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এই রিপোর্টটিই আপাতত স্রেফ পাথুরে জড় থেকে জৈব যৌগ এবং অ্যামোনিয়া উত্পত্তির সর্বশেষ সম্ভাব্য খতিয়ান (https://www.nature.com/articles/s41586-018-0684-z)।

জীবনের শুরু তাহলে আত্মা থেকে আত্মায় হয়তো নয়, পৃথিবীর সাগরের তলার পাথুরে জমি থেকে যাত্রাটা শুরু হয়েছিল, আর আপাতত যাঁর হাতে এই কাগজটি ধরা আছে, সেই প্রাণীটির জাতি অব্দি সেই প্রাণ ভ্রমণ করেছে মাত্র! আসলে, আমাদের সকলেরই জন্মদিন ঐ সময়টা, স্থান, ঐখানে।

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়