ওকে ভালোবাসি, বললো সূর্য্যতপা।
মৃত্তিকা দাঁতে দাঁত চিপে বললেন, অকৃতজ্ঞ! আজ থেকে তোমার জল, খাবার, সব বন্ধ! যারা তোমায় নিয়ে এলো, বড় করলো, তুমি তাদেরকে মন না দিয়ে দেবে কাকে, ওই কালো কুচ্ছিত পোকাটাকে!
সূর্য্যতপা কেঁদে ককিয়ে উঠে বললো, না মা, ওকে কালো কুচ্ছিত বলো না। ও কিরকম খাটতে পারে, তুমি দেখো নি, ঐ মানুষের থেকেও অনেক বেশী। ওই পারে, হ্যাঁ, শুধু ওইই পারে, আমায় নিয়ে যেতে, দূরে, দূরে, আরো দূরে!
মৃত্তিকা নির্মমভাবে ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠলেন, খোঁড়া মেয়ের সখ দেখ না, দূরে যাবে! তোর বাপ একদিন খুব গর্ব করে তোকে নিয়ে এসে দিয়েছিলো আমার কোলে, তারপর তো তার আর পাত্তা নেই। একলা মা হয়ে তোমার মতো খোঁড়া মেয়ে মানুষ করার কি জ্বালা তুমি কি বুঝবে? মরুৎ জানতো, সব জানতো, তুই যে এরকম প্রতিবন্ধী হবি, আগেই জানতে পেরে সে কাপুরুষের মত পালিয়ে গেছে!
জলভরা চোখে সূর্য্যতপা বললো, বাবার কী দোষ মা, আমার জাতটাই তো এরকম, আমার কোথাও যাওয়ার কোনো জো নেই! খালি একজায়গায় দাঁড়িয়ে সবার সেবা করা।
পাদপদের যে কোথাও চলে ফিরে যাবার উপায় নেই, মৃত্তিকা জানেন। তবু ছেলে মেয়ের এমন কষ্ট পাওয়া তিনি সহ্য করতে পারেন না। দুই রকমের সন্তান তাঁর, তার মধ্যে এই পাদপজাতি তাঁর চক্ষের মণি, ওরা অসহায় বলে আগলে রাখতে চান সবসময়। বকাঝকার মধ্যেও তাই মিশে থাকে স্নেহ, মায়া, মমতা।
সূর্য্যতপা সেটা বোঝে।
ওর যে না বুঝলে চলে না। কৃষ্ণভ্রমরের ডানা ঝাপটানোর শব্দে ওর হৃদয়ে কী যেন একটা হয়, ও নিজেও জানে না! ওর না আছে কান, না আছে নাক, না আছে মুখ। তবু ও শুনতে পায় কৃষ্ণের আসার শব্দ।
এসো কৃষ্ণ, এসো আমার ঘরে এসো, আরো হাজারো একটা শব্দের মাঝে আমি তোমার বাঁশি আলাদা করে শুনতে পাই, আমি শুনতে পাই, আমরা সূর্য্যতপারা শুনতে পাই, আমার মতো আরো অনেক অনেক গাছ, শুনতে পায়। মানুষ, তুমি শুনতে পাচ্ছো? আগের চাইতে কুড়িগুণ বেশি মধু তৈরী করেছি বুকে, হে কৃষ্ণ, তুমি এসো, আমায় নিয়ে চলো, যে জগৎ দেখিনি, যাকে দেখিনি, তাকে দেখাও, ভ্রমর, তুমি এসো,
এসো, এসো, এসো প্রিয়, এসো আমার ঘরে,
আমার মনের অন্তঃপুরে স্বপ্নভেজা পথটি ধরে।
স্বপ্নভেজা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে উদ্ভিদ, প্রিয় কৃষ্ণভ্রমর তাকে হাঁটিয়ে ছুটিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়। যেখানে সে কোনোদিন স্বপ্নেও যাবার কথা ভাবে নি, একদিন সেখানে সে ছড়িয়ে যায়। একদিকে ভ্রমর, আরদিকে তার ভালোবাসার উদ্দেশ্য।
একদিন পরাগসংযোগ সম্পূর্ণ হয়। সম্পূর্ণ হয় ইজরায়েলের তেল-আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের গবেষণাটি (https://doi.org/10.1101/507319)। হ্যাঁ, সূর্য্যতপা (sun-drop or evening primrose) এবং হয়তো ওর মতো আরো অনেক গাছেরা শুনতে পায়। শুনতে পায় তাদের বহু-প্রতীক্ষিত শব্দটি, এমনকি পারিপার্শ্বিক কলরবের ভেতর থেকে স্ক্যান করে নেয় সেটি। মৌমাছির ডানা-ঝাপটানোর শব্দে তার মকরন্দ-ক্ষরণ বেড়ে যায় কুড়ি গুণ। যাতে তার পায়ে লেগে পরাগরেণু ছড়িয়ে পড়তে পারে, জীবন যে একটাই, আর জগৎ অনেক বড়ো, প্রিয়।
© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়