Thursday 31 May 2018

প্রোটনের পেটের ভেতরের চাপ

                   চাপের ব্যাপার!

কদিন ধরে হেভি চাপ চলছে! এমনিতেই মরার অনেক পরে বুঝেছিলাম মরে গেছি তাই নিয়ে চাপটা ছিলোই। মেঘলা আকাশের মত গুমোট মন নিয়ে গঙ্গার ধারে ঠ্যাং ঝুলিয়ে ভৌতিক বিড়ি ফুঁকছিলাম আর ভাবছিলাম ‘জেবনে আর কিছু হলো না!’

এমনি সময় লোকটা জল থেকে উঠে এলো। ভিজে নয়, শুকনো অবস্থায়। আমি ঘাবড়ে গেছি দেখে বললো - ঘাবড়াও কেন, তুমি তো অলরেডি পটল তুলেছো, এখন তুমি নেই। মানে ভূত, অতীত।

আমি বললাম, তা ঠিক, তবে এখনো ঠিক প্র্যাকটিস হয়নি তো, তাই ভয় লাগে। তা তুমি কী, আমার মতোই নিশ্চয়, নইলে জলে থেকেও এমন শুকনো কেন?

লোকটা একটা পিত্তিজ্বালানো হাসি হেসে বললো, আমি তোমার মতো নই। আমি আছি, মানে মরবো না কোনদিন, গ্যারান্টি। আমি জলেও আছি, বাতাসেও আছি, সূর্যে এমনকি মহাশূন্যেও আছি।

আমি রেগে বললাম, এসব ঢপ বন্ধ করো। যখন বেঁচে ছিলাম, দুটো মাতব্বর এমনি ঢপ দিতো। তাদের কথা বিশ্বেস করে আজ আমার এই দশা। তুমি কি বাবা লোকনাথ?

লোকটা বললো, তা বলতে পারো, আবার প্রোটনও বলতে পারো, জলের অণুর দিব্যি, এইমাত্র একটা অণু ফুটে, ইয়ে মানে, তোমরা যাকে স্বতঃবিয়োজন বলো, তা হয়ে বেরোচ্ছি।

আমি বললাম, বটে? তা তুমি যে প্রোটন তার প্রমাণ কি হে?

লোকটা হাত দুটো উপরে তুলে পা দুটো ছেতড়িয়ে দাঁড়িয়ে বললো, এই দ্যাখো তোমাদের ইনজিরি এইচ অক্ষরের মতো দেখতে লাগে কিনা। আর এই যে মাথার পেছনের টিকি, এইটা আমার প্লাস চার্জ। হলো কিনা!

আমি বললাম, এ বাবা, এতো সরল! তুমিই সেই যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকো?

লোকটা বললো, হ্যাঁ গো বাঙালির ভূত, হ্যাঁ।

আমি হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বললাম, তুমিই সেই আদিকণা যার সংখ্যা বলে দেয়, মৌলটা কী হবে?

লোকটা গদগদ হয়ে বললো, যা বলেছো ভাগাড়ের ভূত। তারপর কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। বললো, তবে আজকাল জানো কেউ পাত্তা দেয় না। সে রাদারফোর্ড ও আর নেই, সে পরমাণুও আর নেই। তুমিই বলো, আদিকণা হিসেবে আমি কম হলাম কিসে!

আমি সবে ঘাড় নেড়ে তাকে শান্ত করতে যাচ্ছিলাম, এমনি সময় প্রোটন, অথবা প্রোটন নামের লোকটা কেমন একটা করতে থাকলো। পেট ধরে চ্যাঁচাতে লাগলো, আর মাঝে মাঝে কাকে যেন বলতে লাগলো, হতভাগার দল, আমাকে তোরা শান্তিতে থাকতে দিবি না, বাঙালির ভূতের সামনে বেইজ্জত করছিস!

আমি বললাম, পেটে গ্যাস হয় তো ইউনেনজাইম খেলেই পারো।

লোকটা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললো, ইঃ! তোমার যেমন বুদ্ধি! গ্যাস হতে যাবে কি সে! তুমি কোয়ার্কের নাম শোনো নি বুঝি?

আমি বললাম, ইস্কুলে মাস্টার ছিলো না বলে বিজ্ঞানের ক্লাস বন্ধ ছিলো, বাংলার মাস্টার পরমাণুর পেটে কি আছে ওই জানিয়েছিলো। তোমার পেটে কি আছে তা জানার সৌভাগ্য হলো কই!

প্রোটন বললো, ওই যে তুমি আমায় আদিকণা বললে, তাইতে হতভাগাদের প্রেস্টিজে লেগেছে। ওরা তিন পিস্ কোয়ার্ক, আমায় নাকি গড়েছে বলে দাবি করে। উঃ বাবারে! গেলুম গেলুম! আর নাচিস না। হ্যাঁ হ্যাঁ, তোরাই আদিম যুগের কণা, নে হয়েছে?

আমি বললাম, তিনটে কোয়ার্ক? ওদেরকে বাইরে বের করে দাও না।

প্রোটনটা বললো, সে বলা ভারি সোজা। ওরা দুটো এক চরিত্রের আরেকটা আলাদা। তোমাদের পন্ডিতগুলো ছিলো তাই রক্ষে। ওদের দুটোকে নাম দিয়েছে ‘আপ’ কোয়ার্ক। আর একটার নাম ‘ডাউন’ কোয়ার্ক। আমার পেটের বাইরে বার করলে ওদের বুঝতে পারবে না, এমনি চালাক। কেবল আমি বুঝি ব্যাটাদের শয়তানি, উরে বাবারে!

আমি বললাম, ডাক্তার দেখিয়েছো?

প্রোটন বললো, তা আবার নয়? ভালো ডিগ্রিধারী নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট দেখিয়েছি! কি বললো জানো? বলে কি না ওই তিনটে বজ্জাত পেটের ভিতর এমনি আঁটাআঁটি করে বসেছে যে বার করার জো নেই! এতোটাই শক্ত ওদের নিজেদের মধ্যে টান! ওর নাম দিয়েছে নিউক্লীয় বল। আরেক ডাক্তার বলেছে, ওই বল ফল বলে কিছু নেই। কোয়ার্ক আছে, আর ওদের মাঝে আঠার মতো একরকম কণা আছে, যাকে বলে গ্লুওন। অবিশ্যি, অনেক ডাক্তারে ওদের কণা বলে ধরেনা, বুঝলে? কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স বলে একটা ব্যাপার আছে….উরেঃ বাপস্, আর লাফাস নে!

আমি দেখলাম, ব্যাটা পেট ফেটে মরে আর কি! কাজেই যা জানার এই বেলা জেনে নি। জিগ্যেস করলাম, কোয়ার্ক গুলোর নিজেদের মধ্যে এই যে ভয়ানক টান, সেই টানে তো নিজেরাই নিজেদের সাথে ঠোক্কর খেয়ে মিলিয়ে যাবে, তখন তোমার কি হবে ভেবে দেখেছো?

প্রোটন বললো, আরে সেই কথাই তো তোমায় বলতে আসছিলাম, তোমায় মনমরা দেখে! ডাক্তারগুলো এই সন্দেহটা অনেককাল আগে থেকেই করছিলো! টান যদি থাকে, ঠ্যালাও থাকবে, নইলে আমি বাঁচি কিভাবে? আর আমি না বাঁচলে তোমাদের কি হবে গো?

আমি দেখলাম, প্রোটনটা আবার ক্রেডিট নিতে যাচ্ছে! তাই তড়িঘড়ি বললাম, তারপর ঠ্যালার ব্যাপারটা জানা গেলো?

সে বললো, এই তো এবছর মে মাসের মাঝামাঝি, আমেরিকার থমাস জেফারসন ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটার ফেসিলিটি সেন্টারে আমরা গেছিলাম, আমার মতো অনেক হতভাগা প্রোটন পেটে কোয়ার্ক নিয়ে ডাক্তার ভোলকার বার্কার্টের চেম্বারে ভর্তি ছিলো  (doi:10.1038/s41586-018-0060-z)। তো ওরা বেশ জোরালো ইলেকট্রন রশ্মি আমাদের পেটে ফেলে টেলে দেখলো, কোয়ার্কগুলো কেম্নি করে! শেষে ওদের ভরবেগ আর শক্তির কতকগুলো ম্যাপ এঁকে টেকে বললো, চাপের ব্যাপার।

আমি বললাম, চাপের ব্যাপার? মানে?

সে বললো, আমিও এই রকম জিগ্যেস করেছিলুম, বুঝলে, তাতে ওরা গম্ভীর হয়ে বললো, আমার পেটে নাকি দুরকম চাপ! আর এটা নাকি ওরাই প্রথম বের করতে পেরেছে। বিশ্বেস না হয় নেচার পত্রিকায় দেখো, 16ই মে বেরিয়েছে! একটা চাপ ভিতরে ঠেলছে কোয়ার্কদের, ওটা অতোটা ভয়ানক না হলেও যে চাপটা পেটের মধ্যিখানে কাজ করছে, সেটা কোয়ার্কগুলোকে বাইরের দিকে ঠেলছে। এই দুটো চাপ নির্ঘাত ব্যালেন্স করছে, আমি তাই বেঁচে যাচ্ছি! কোয়ার্কগুলো পেটের ভেতরে টিকে থাকছে।

আমি বললাম, এই ব্যাপার! এতে এতো প্রচারের কি আছে হে? মধ্যিখানের এই চাপটা কি আমার মনের চাপের থেকেও বেশী?

প্রোটনটা এই শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে এমন হাসলো যে আমার বিড়িটা নিভে গেলো! হাসি থামিয়ে বললো, তুমি যখন বেঁচে ছিলে, তখন তোমার উপর বাতাসের চাপ কতটা ছিলো জানো?

আমি বললাম, এটা সেভেনের! ওই 10 টু দি পাওয়ার 5 পাস্কালের মতো! মানে একের পিঠে পাঁচটা শূন্য, এক লাখ পাস্কাল, প্রায়।

একটু থেমে বললাম, ইয়ে মানে, সমুদ্রপৃষ্ঠে!

সে বললো, এইটুকু চাপ তোমরা নিতে পারো না বলে তোমাদের গায়ে আবার ফুটো করে বাইরে ভেতরে চাপ সমান করতে হয়েছে! ছোঃ! আর আমি পেটের মধ্যিখানে 10 টু দি পাওয়ার 35 পাস্কাল চাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, উইদাউট ফুটো!

আমি স্রেফ হাঁ। প্রোটনটা বলে কি? 10 টু দি পাওয়ার 35 পাস্কাল মানে একের পিঠে পঁয়তিরিশটা শূন্য! সে যে ব্রম্ভাণ্ডের সবথেকে ঘনীভূত বস্তু নিউট্রন তারকার পেটের চাপের থেকেও দশ গুণ বেশী চাপ!!

আমি বললাম, এ-তো চা-প! কিভাবে নাও ভাই?

সে বললো, ওইটাই তো বলতে আসছিলাম, ভিতরে এতো চাপ নিয়েও আমি যদি পজিটিভ থাকতে পারি তবে তুমি, যে কিনা আমাকে দিয়েই তৈরী, সে কেন চাপের মুখে মনমরা, প্রিয় ভাগাড়ের ভূত? বি পজিটিভ, লাইক মি, এই বলে নাচতে লাগলো!

আমি বললাম, ইসস্! ডাক্তার বার্কার্ট কেন আর কদিন আগে চাপের ব্যাপারটা জানালেন না! তাহলে চপের দোকানটা দিয়ে সংসারটা টানতে পারতাম! এইসব ভাবছি এমনি সময় দেখি জল থেকে একটা মোটা সোটা হাইড্রোক্সিল আয়ন উঠে ইলেকট্রনিক জিভ বার করে সুড়ুত্ করে প্রোটন টাকে টেনে নিয়ে গিলে ফেললো!

তোমরাই বলো, এসব চাপের ব্যাপার কি না!

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Sunday 6 May 2018

অন্তিম পর্ব: সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

      পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া
                          
                           অন্তিম পর্ব

     ‘আলোর ঢেউয়ে উঠলো নেচে মল্লিকা-মালতী’

এক মিটারের দশলক্ষ ভাগের এক ভাগকে বলে মাইক্রোমিটার। সোডিয়াম আর সিজিয়ামের পরমাণুর ভেতরে ব্যবধান ছিল তিন মাইক্রোমিটার! চোখে তো তা নিশ্চয় দেখা যায় না। এই সব কান্ডকারখানা যা ঘটছে, বিজ্ঞানীরা তা দেখছেন আসলে কম্পিউটারের পর্দায় পরমাণুর ছায়া হিসেবে। বাইরে থেকে দেখলে নইলে কেবল আলোটুকু দেখা যাবে! কোন আলো, কিরকম আলো, কোন পরমাণুকে ধরে আছে এসব দেখাতে অনেক রকম আয়না আর লেন্সওয়ালা সেরকম ওস্তাদ যন্তর আছে বটে, তবে সে সব বোঝার জন্য চাই জহুরির চোখ। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তিল তিল করে জমানো হাজার হাজার মানুষের বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতার ফসল সেসব জহুরির মাথায়।

এখন বিক্রিয়া ঘটাতে গেলে পরমাণুদের আগে কাছে নিয়ে আসতে হবে। সোডিয়ামের আলোক চিমটে স্থির রেখে তার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিয়ে আসা হল সিজিয়ামের 976 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক চিমটেটা। দুটো আলো যখন মিশে গেল, নিভিয়ে দেয়া হল সোডিয়ামের চিমটে। এখন 976 ন্যানোমিটারে দুই পরমাণু রয়েছে আটকে। একই বাড়িতে বউমা সোডিয়াম (Na) আর শাশুড়ি সিজিয়াম (Cs), মিলমিশ হবে কি না সেটা কপালের ব্যাপার, কিন্তু ঠোকাঠুকি?

পরমাণুদের ঠোকাঠুকি হলেই যে তাতে তারা জুড়ে গিয়ে নূতন অণু দেবে তার গ্যারাণ্টি নেই। প্রথমে তো তাদের মাথায় রাখতে হয় ভরবেগ আর শক্তির নিত্যতা সূত্রগুলো তার উপর আবার সঠিক সময়ে, সঠিক মেজাজে না এলে পরমাণুদের মিলমিশ হয় না। না, ক্যাং কুয়েন নি এর কাছে পরমাণুদের খোশমেজাজে আনার জন্য ক্যাডবেরি ছিলো না, ছিলো ফের আরেকরকমের আলো। যে পরমাণু যেরকম আলো খেলে মিনিমাম উত্তেজিত হয়, সেই রকমের আলো দেওয়া হলো তাদের, আর বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বোঝা গেল, একটি অণু জন্ম নিয়েছে বটে! NaCs* স্বাভাবিক নয়, উত্তেজিত অণু, তবে দেখা দিয়ে সে গেছে মিলিয়ে! এর আগে কখনো এরকম সূক্ষ্মভাবে, সরলাকারে, স্রেফ দুটো পরমাণু পাকড়ে একপিস্ অণু তৈরী করা যায় নি। মানুষ এই প্রথম এভাবে অণু তৈরী করতে শিখলো। বা বলা চলে অণু তৈরী নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলো। যে জিনিস ভাগ্য বা প্রকৃতির হাতে ছাড়া হয়েছিলো, তার উপরে মানুষের কন্ট্রোল এলো, অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ হলেও। মানুষ এরকম ভাবে অণু তৈরী শিখলে আশা করা যায় আণবিক কম্পিউটার তৈরী করতে বেশী বছর লাগবে না।

সাধারণ কম্পিউটার যে পরিমাণ তথ্য ধরতে পারে তার মূলে থাকে বাইনারি বিট ব্যবস্থা, 0 আর 1 শুধু এই দুই অবস্থা দিয়ে সেটা চলে। পরমাণু, ফোটন বা ইলেকট্রন দিয়ে যখন সেই তথ্য ধরা বা আদানপ্রদানের কাজটা চলে তখন তাদের বলে কিউবিট। কিউবিট শুধু 0 আর 1 নয়, এমনকি তাদের মাঝামাঝি অনেকরকম অবস্থায় থাকতে পারে। কাজেই বিটের সাহায্যে যে পরিমাণ তথ্য জমানো যায়, কিউবিটের মাধ্যমে তার থেকে বহুগুণ বেশী তথ্য ধরবে। মানে অনেক ছোট হয়ে যাবে কম্পিউটিং ব্যবস্থা। কিউবিট ব্যবস্থা কোয়াণ্টাম কম্পিউটারের মূল অস্ত্র। তাই এককভাবে অণু তৈরী করার চেষ্টার পিছনে আসলে আছে সেই অণুকে কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য। ইলেকট্রন বা ফোটনের তুলনায়, একটি অণু কিউবিট হিসেবে অনেক সুবিধাজনক।

বিজ্ঞাপনে ক্যাডবেরির আমেজ ফুরানোর পরে শাশুড়ি বউমার মিলমিশ টিকেছিলো কি না দেখায় নি, তাই বলে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েন নি-- স্বাভাবিক অবস্থার একটিমাত্র অণু হাতে গরম তৈরী করা যায় কিনা তা জানতে ক্যাং কুয়েন নি এর টিম এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকের ভল্টে উন্নত কোয়ান্টাম পাসওয়ার্ড দিয়ে সুরক্ষিত আপনার টাকাপয়সার জন্য, ভবিষ্যতে, একদিন হয়তো এইসব নিরলস মানুষদের মন থেকে থ্যাংকিউ জানাবেন।

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
@https://chemssb.blogspot.in

Friday 4 May 2018

তৃতীয় পর্ব: পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

  পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া
                      
                          পর্ব. তিন:
         আলোর চিমটে কিভাবে কাজ করে

                “যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
              আমি তোমায় ছাড়বো না, মা!”

পরমাণু বা অণুর মধ্যে ইলেকট্রন যখন নাচানাচি করে তখন তার থেকে হয় শক্তি বেরোয়, নয় তাতে শক্তি ঢোকে। উল্টোটাও সত্য। মানে শক্তি ঢোকা বেরনো হলে ইলেকট্রন নাচানাচি করে। যাই হোক, যদি চার্জওয়ালা ইলেকট্রন নাচে তো তার আশেপাশে থাকা ইলেকট্রিক অঞ্চলটাও নাচতে থাকবে আর সেই নিয়মে তার সাথে নব্বই ডিগ্রি কোণে একটা চৌম্বক জায়গাও তৈরী হয়ে নাচতে থাকবে ম্যাক্সওয়েল সাহেবের কথা মেনে। এইরকম নাচতে থাকা ইলেকট্রন যখন শক্তি ছাড়ে, তখনো ওই ছেড়ে দেয়া শক্তি, ওই দুই ইলেকট্রিক আর চৌম্বক অঞ্চলদের বয়ে নিয়ে চলে! এইরকম শক্তিকে আমরা বলি-- আলো। শক্তির নেই ওজন, নেই আধান, তবু কি অদ্ভূত, ইলেকট্রিক আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা অঞ্চল বা ক্ষেত্র তাকে ছাড়তে চায় না, সত্যিকারের শক্তি উপাসক! শক্তির ঢেউ যদি x অক্ষ বরাবর ছোটে, নাচতে থাকা ইলেকট্রিক ক্ষেত্র থাকে y বরাবর আর চৌম্বক ক্ষেত্র z বরাবর।

আলোর এই ইলেকট্রিক ক্ষেত্রের গুণেই পরমাণুদের ধরতে পারি আমরা। বস্তুত, যে জিনিসে চার্জ থাকবে + বা -, তাদের আলো ধরতে ওস্তাদ। আয়ন ধরা খুব সোজা শক্তিশালী আলো দিয়ে। তবে দুটো লেজার আলোকে অভিসারী করতে হবে ভালো লেন্স দিয়ে আর তারা মিলবে যেখানে মানে ফোকাস পয়েন্ট যেটা ওইটে হলো আলোক চিমটের আগা। এখন, পরমাণুতে আছে দুরকম চার্জ, সমান সমান। আলোর ইলেকট্রিক ফিল্ডের বিকর্ষণে পরমাণুর ইলেকট্রন যাবে একদিকে সরে। আর পরমাণুর নিউক্লিয়াস এগিয়ে আসবে ইলেকট্রিক ফিল্ডের টানে! অর্থাত্ একটু আগের সুন্দর ফুটবলের মতো পরমাণুর গঠনটা যাবে ধেবড়ে। একটু আগেও যেটা ছিল নিস্তড়িত্ এখন সেটাই হয়ে যাবে একটা দ্বিমেরু বিশিষ্ট চুম্বক বা বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘ডাইপোল’! বড়ো চুম্বকের চারপাশে যেমন অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র থাকে, যার কাছে একটু লোহার পেরেক আনলেই তাকে সড়াত্ করে টেনে নেয় চুম্বক, এও অনেকটা এরকম। আলোর সাহায্যে জন্ম নেয়া ডাইপোলের নাম-- অপটিক্যাল ডাইপোল।

কিন্তু এখানে আবার আরেকটু মুশকিল আছে! আলো যে পরমাণুকে ইলেকট্রিক ফিল্ড দিয়ে শুধু যে টানছে তা নয়, আলোর ফোটন কণা আবার পরমাণুটাকে ক্রমাগত গুঁতোচ্ছে। ফিল্ড বলছে আয় আয়, ফোটন বলে পালা পালা! যখন এইদুটো বিপরীতমুখী বল একে অন্যকে ব্যালান্স করতে পারবে, তখন শুরু হলো লেজারের ফাঁদে পরমাণুদের আটকে পড়া। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে অপটিক্যাল ডাইপোল ট্র্যাপ। আলোর চিমটে যতভাবে মানুষ কাজে লাগায়, এটা হলো তার একটা পদ্ধতি।

এভাবেই পরমাণুদের হাঁড়ি থেকে শক্তিশালী লেজার ব্যবহার করে তোলা হয়েছিল একটা পরমাণুকে। এটা অনেকটা হাত মুঠো করে বালি তুলে সেই হাত থেকে সব বালি ফেলে আঙুলের ফাঁকে একটিমাত্র বালুকণা রেখে দেবার মতো ব্যাপার, যতক্ষণ না একটি পরমাণু চিমটের আগায় ধরা যাচ্ছে ততক্ষণ কাজটা চলছিল। ঠিকঠাক মাপ করে তুলতে হতো একটা সিজিয়াম আর একটা সোডিয়াম পরমাণুকে। সিজিয়াম বাঁশকাঠি চালের দানা হলে সোডিয়াম হল গোবিন্দভোগ চালের দানা। কাজেই একরকমের চিমটেতে কাজ চলবে না!

পরমাণু যত বড় হয় তাকে ধেবড়ে ডাইপোল বানাতে আলোর তত কম শক্তি লাগে। এ হিসেবে সোডিয়াম ধরতে বেশি শক্তির আর সিজিয়ামের জন্য কম শক্তির লেজার আলো লাগবে। এখন আলোর ঢেউ গুলোর মধ্যে দূরত্ব কম হলে আলোর শক্তি বেড়ে যায়। সাধারণত, এই দূরত্ব মাপে ন্যানোমিটারে (1 মিটারের 100 কোটি ভাগের 1 ভাগে)! এর বৈজ্ঞানিক নাম তরঙ্গদৈর্ঘ্য। এই কারণে সোডিয়াম পরমাণু ধরতে বেশি শক্তির 700 ন্যানোমিটার আর সিজিয়াম পরমাণু ধরতে কম শক্তির 976 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেজার আলো ফেলা হল। একটা চিমটেয় সোডিয়াম আর একটা চিমটেয় সিজিয়াম পরমাণু ধরার পরে বিজ্ঞানীরা বন্ধ করে দিলেন ছয়দিক থেকে পড়া লেজারের ঝর্ণাধারা আর চারমুখো সেই চৌম্বক ক্ষেত্রটাকে, পরমাণুর হাঁড়ি, গোদা বাংলায় বলা চলে, ফেটে গেলো! প্রায় বায়ুশূন্য স্থানে ভেসে রইলো সোডিয়াম আর সিজিয়ামের একটি একটি পরমাণু, লেজার চিমটের ডগায়।

শাশুড়ি সিজিয়াম পরমাণু আর বউমা সোডিয়াম পরমাণুর মধ্যে দূরত্ব এখন কত হতে পারে, আন্দাজ?

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Tuesday 1 May 2018

পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া :পর্ব 2

     পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

                                দুই.

           “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
                ক্যামনে আসে যায়
             ধরতে পারলে মন-বেড়ি,
                দিতাম পাখির পায়!”

পাখি মানে পরমাণু শান্তশিষ্ট না হলে ধরা মুশকিল! আগে ওকে ঠান্ডা মাথায় ঠান্ডা করতে হবে, সাধক বুঝেছিলেন।

সুপারসোনিক জেটের থেকেও দ্রুতগামী পরমাণুদের ছয় দিকের লেজারের ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে শীতল করলে তাদের বেগ কমে নিদেনপক্ষে অলিম্পিক স্প্রিন্টারদের মতো হয় (“লেজারের ঝর্ণাধারায়” দ্রষ্টব্য)! আলোকীয় এই চিটেগুড়ে পরমাণুপুঞ্জ যখন ছটফটাচ্ছে তখন এর সাথে সঠিক দিক থেকে সঠিক মাপের চারমুখো চৌম্বকক্ষেত্র (সাধারণ চুম্বক দুইমুখো, উত্তর আর দক্ষিণ মেরু) বসিয়ে দিলে ষোলকলা পূর্ণ। পরমাণুগুলো এখন পিঁপড়ের মতো হেঁটে বেড়াবে, আলো আর চুম্বকের সম্মিলিত খাঁচার ভেতর! অবশ্য খাঁচা না বলে একে তিহার জেলখানাও বলা যায়। বাই চান্স কোন পরমাণু পাঁচিল টপকে পালাতে গেলে লেজারের ফোটন পুলিশ তাকে লাথি মারতে মারতে একেবারে ফাঁদের মধ্যিখানে এনে ফেলবে। একেবারে আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা ব্যবস্থা! গোপন কথাটি হলো, ক্ষারধাতুর পরমাণুগুলোকে সহজে এমন জেলে বন্দি বানানো যায়। আর একটা লোমহর্ষক ব্যাপার, জেলখানার ভেতর বাতাসের চাপ আমাদের ঘরের চাপের দশ লক্ষ কোটি ভাগের মাত্র এবং মাত্র-- একভাগ! সুতরাং পরমাণুগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি বা ধাক্কাধাক্কি করতে পারে না। এতে করে ওরা খুব শান্ত শিষ্ট হয়ে যায়। তাপমাত্রা নেমে যায় এক কেলভিনের দশলক্ষভাগের একভাগে!! ছয়দিক থেকে আসা লেজার রশ্মি আর চারমুখো চুম্বকের ফাঁদে পড়ে প্রায় বায়ুশূন্য একটা স্থানে মেঘের মতো ভেসে থাকে একগোছা পরমাণু। মোটের উপর এই হলো গিয়ে মোট-- MOT Magneto Optical Trap.

আর এইটাই হলো বিজ্ঞানীর জন্য “পরমাণুর হাঁড়ি”!! এই পরীক্ষায় দুটো এরকম হাঁড়ি আছে যার একটার মধ্যে ফেলা আছে কয়েকদানা বাঁশকাঠি চালের মতো সিজিয়াম পরমাণু আর অন্যটাতে কয়েকদানা গোবিন্দভোগ চালের মতো সোডিয়াম পরমাণু। “জল” মানে ফাঁকা জায়গা এতো বেশী হাঁড়িতে যে চালের দানাগুলো খুব দূরে দূরে থেকে লাফালাফি করছে! আপনাকে একটা কাঠি দিয়ে চাল তুলে দেখতে বলা হলো চাল সেদ্ধ হয়েছে কি না?

লাফালাফি করা চালের দানাকে আপনি একটা কাঠিতে তুলতে হিমসিম খেতে পারেন, কিন্তু যদি আপনাকে দুটো কাঠি বা একটা চিমটে দেওয়া হয় তবে আপনি আরো ভালো ভাবে একটা চালের দানা তুলে দেখতে পারবেন, এ বিষয়ে হলফ করে বলা যায়। চিমটে দিয়ে আপনি তাহলে ঠিক কি করেন? তাগ্ করেন বা ফোকাস করেন চালের দানাকে।
ঠিক একইভাবে পরমাণুর আপাতঠান্ডা হাঁড়ি থেকে একটা পরমাণুকে তুলতে বিজ্ঞানীর চাই শক্তপোক্ত ফোকাসওয়ালা লেজার রশ্মি। এটাই হলো গিয়ে আলোকীয় চিমটে।

দৃশ্যটি ভাবুন। যেন মহাকাশযান থেকে লেজার রশ্মি নীচে পড়লো আর চোখের পলকে তুলে নিল গরু মোষ নেতা এমনকি আপনাকেও! কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে বিজ্ঞানের হালকা ছোঁয়া তো থাকবেই।

এগিয়ে আসুন, যতই উদ্ভট শোনাক, আলোকীয় চিমটে কিন্তু সত্যি।

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়