Sunday 26 August 2018

ক্রেবসের সাইকেল

২৫ শে অগাস্ট, ২০১৮

পুরোনোতুন সাইকেলটা

সাইকেলটা আমাদের সব্বার ইস্কুলে ছিল, আছে অনেকদিন ধরেই, না না, এ জিনিস সদ্য পাওয়া সবুজসাথীর নয়, এ অনেক পুরোনো। আমরা, পছন্দ করি বা না করি, এটা প্রায় সবাইকেই চড়তে হয়েছে, এখন অবিশ্যি আমি চড়াই, নিজে চড়ে কদ্দূর এক্সপার্ট হইচি সে বলা যায় না।

দাঁড়ান, সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে আপনাকে একটা ছবি দেখাই। ঘ্যাং! নীচের প্রথম ছবিটা একটা যন্তরের। এ দিয়ে মাপা হয় কোষের শ্বাস-প্রশ্বাস। হ্যাঁ, সেই কোষ, যে গুলো ইঁটের পরে ইঁটের মতো গেঁথে তৈরী হয় আমার আপনার যাকে বলে বডি! বডিকে জ্যান্ত থাকতে গেলে কোষকে জ্যান্ত থাকতে হবে। কোষ যে জ্যান্ত তার প্রমাণ সেটা বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়। কেন নেয়? কোষের মধ্যে থাকে পাওয়ার প্যাক গ্লুকোজ, তাকে এই অক্সিজেন ভাঙবে, ভাঙলে বেরবে শক্তি, সেই শক্তির দাক্ষিণ্যে কোষের যত কায়দাবাজি, লম্ফঝম্প, ইত্যাদি। আর তার থেকেই আমরা জ্যান্ত মানুষ! তো এই কোষগুলো কতটা করে অক্সিজেন নেয়, সেটা মাপার এই হল সীল-করা যন্তর, যাকে বলে রেসপিরোমিটার, রেসপিরেশন মানে যেহেতু শ্বসন। যন্তরটার ভেতরে জ্যান্ত কোষ আছে, অণুজীব বা টিস্যুর অংশবিশেষ, টিস্যু মানে একরকম কোষেদের পরিবার, বাংলায় যাকে বলে কলা। তো তারা অক্সিজেন নিলে ছাড়বে কার্বন ডাই অক্সাইড, সেই গ্যাস শুষে নেবার মত একরকম রাসায়নিক রাখা আছে যন্তরটার ভেতরে। সেটা সোডা লাইম কিংবা কস্টিক পটাশ হতে পারে। ব্যাপার হল সীল করা যন্তরের ভেতরের অক্সিজেন গ্যাস যদি শুষে নেয় কোষ, আর কোষ থেকে বেরনো কার্বন ডাই অক্সাইড যদি শুষে নেয় সোডা লাইম বা কস্টিক পটাশ, তাহলে ভেতরে আর গ্যাস বলতে থাকলো কি! এর মানে ভেতরের বাতাসের চাপ কমতে থাকবে। কতটা কমলো দেখার জন্যে এর সাথে জোড়া আছে একটা ইউ আকৃতির কাচনল, যাতে আছে খানিকটা রঙিন তরল, যন্তরটার ভেতরের গ্যাসের চাপ কমা বাড়া করলে সেই তরলটা টিউব দিয়ে এপাশে ওপাশে নড়াচড়া করবে। একে বলে ম্যানোমিটার, চাপ মাপার যন্তর। এইভাবে চাপ মেপে বোঝা যায় কোষে কতটা অক্সিজেন নিচ্ছে, তার থেকে বার করা যায় কোষের শ্বসনের হার। এই রেসপিরোমিটারের আইডিয়া নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জার্মানীর বায়োকেমিস্ট অটো ভারবুর্গের, যাঁর ল্যাবে কাজ করতেন আমাদের ওই সাইকেলের মালিক ডাক্তারবাবুটি।

কোষ অক্সিজেন নিয়ে গ্লুকোজকে দড়াম করে একধাপে ভেঙে ফেলতে পারে না! পদ্ধতিটা হয় ধাপে ধাপে। এতে অনেকরকম বিক্রিয়া ঘটে। সেইসব বিক্রিয়া ঘটাতে দরকার হয় অনেকরকমের উত্সেচক, যারা বিক্রিয়াগুলোকে তাড়াতাড়ি ঘটাতে সাহায্য করে, অনেকটা একশোদিনের কাজে মাটিকাটার পরে যেরকম সারি সারি শ্রমিক লাইন দিয়ে সেই মাটির ঝুড়ি একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় বয়ে দেন, সেরকম। প্রতিবার ঝুড়ি হস্তান্তরের সময় ইলেকট্রন আদানপ্রদান ঘটে অণুদের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। এইসব উত্সেচক নিয়ে কাজ করে ১৯৩১ সালে ভারবুর্গ সাহেব চিকিত্সাবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পান। কিন্তু তখনো কোষীয় শ্বসনের সম্পূর্ণ ধাপগুলো বিজ্ঞানীরা জেনে উঠতে পারেন নি। প্রথম ধাপটা ঘটে কোষের সাইটোপ্লাজমে। কোষ যদি কাঁচা ডিম হয়, তবে লিকুইড অংশটা তার সাইটোপ্লাজম। এরপরের ধাপে কি থেকে কি হয় সেটার একটা ভাসাভাসা তথ্য ছিলো, কিন্তু ভারবুর্গের সুযোগ্য শিষ্য, আমাদের ডাক্তারবাবুটি যখন বললেন, তিনি ওই রেসপিরোমিটার দিয়েই রহস্য গোটাটাই ভেদ করবেন, ভারবুর্গ পাত্তা দেন নি। বিশ্বাসই করেন নি।

প্রথম ধাপের তৈরী পদার্থগুলো দ্বিতীয় ধাপে কোষের একরকম অঙ্গাণুতে ঢোকে, যার নাম মাইটোকনড্রিয়ন। এখন যেহেতু বাইরে থেকে বিক্রিয়াটাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু ধাপে ধাপে কি পরিবর্তন হচ্ছে দেখার জন্য ডাক্তার এক কায়দা বার করলেন।

শুনতে সহজ লাগলেও ব্যাপার অত সহজ নয়। আগের গবেষণা পড়ে একটা ধারণা তৈরী হয়েছিল যে কী কী উত্সেচক এই কাজে লিপ্ত থাকতে পারে। এটাও বোঝা গেছিল যে দ্বিতীয় ধাপটা একটা চক্রাকারে ঘটা বিক্রিয়ার সমাবেশ। পায়রার বুকের পেশী, যা পায়রাকে উড়তে সাহায্য করে, আর সহজে কখনো ক্লান্ত হয় না, সেই পেশীর কোষ রেসপিরোমিটারে নিয়ে কাজ চালালেন তিনি। একেকবার একেকরকম উত্সেচক ব্যবহার করে করে দেখতে হচ্ছিল কোষের শ্বসনহার কিভাবে প্রভাবিত হয়। তার সাথে কোষটা কি কি রাসায়নিক তৈরী করছে সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হলো। ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতির নিষ্ঠাসহকারে পালন, আর কি! এইভাবে দ্বিতীয় ধাপের চক্রটার সবকটা পর্যায় ক্রমশঃ পরিষ্কার হলো। এই ধাপেই তৈরী হয় কার্বন ডাই অক্সাইড, আর বাকি জিনিস গুলো শেষধাপের বিক্রিয়া ঘটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ডাক্তারবাবু গবেষণালব্ধ ফল সংক্ষেপে লিখে প্রকাশ করতে গেলেন বিখ্যাত জার্নাল নেচার-এ, সেখানে বলা হল, লেখা প্রকাশের জায়গা আর খালি নেই। শেষটায় অন্য  এক পত্রিকায় বড়ো আকারে ছেপে বেরলো এই গবেষণাঃ উচ্চ শ্রেণীর জীবের কোষে বাতাসের সাহায্যে কিভাবে শ্বসন ঘটে তার সদ্য আবিষ্কৃত ধাপ। খাবার খেয়ে পাওয়া শক্তির দুইতৃতীয়াংশ শক্তির জন্ম হয় এই বিক্রিয়াচক্র থেকে। সেই চক্রের রহস্যকে জানা পৃথিবীর ইতিহাসে বিশাল একটা অবদান তো বটেই। সেজন্য ১৯৫৩ সালে ডাক্তারবাবু চিকিত্সাবিজ্ঞানে পেলেন নোবেল পুরস্কার।

এইবার আসল মজার তথ্য, এ রহস্যকে জানার শুরু হয়েছিল জার্মানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে, শেষ হলো ইংলন্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে! কারণ, একমেবদ্বিতীয়ম, শ্রীযুক্ত অ্যাডলফ হিটলার!

ডাক্তারবাবু যখন জার্মানীতে গবেষণা এবং হাসপাতালের কাজ সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় অলরেডি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। জার্মানী থেকে অজার্মানী সবাইকে গলাধাক্কা দেবার ফরমান জারি করেছেন হিটলার সায়েব, যিনি বলেছিলেন, “বিশুদ্ধ জার্মান থাকবে কেবল, ইহুদী বৈজ্ঞানিক চলে গেলে জার্মানী যদি বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়ে, সেও আচ্ছা!” ইহুদী বংশের ডাক্তারবাবুটিও ধাক্কা খেলেন। ইংলন্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লুফে নিলেন রত্নটিকে। মানুষের লিভারে কিভাবে ইউরিয়া তৈরী হয় তা আবিষ্কার করে তিনি তদ্দিনে বিখ্যাত। এ রকম গুণী মানুষকে নিজের দেশ ঠুকরালে কি হবে, বুঝদার দেশ সযত্নে টেনে নেবে।

নিলও তাই। কিন্তু দেশ ছাড়ার আগে সেসময় সব দিয়ে যেতে হচ্ছিলো বিজ্ঞানীদের, ভিনদেশে কোন গবেষণা বা যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে দেবে না নাজি অফিসারবর্গ। লুকিয়ে চুরিয়ে যা নেবার নেওয়া যায়, কিন্তু ভারবুর্গের ডিজাইন করা ওই অতোবড়ো রেসপিরোমিটার? ওটা না হলে যে ডাক্তারবাবুর সব গবেষণাই মাটি হয়ে যাবে!

শেষমেষ নাজি অফিসারেরা সদয় হয়েছিলেন। সেদিন ভাগ্যের জোরে তাদের বদান্যতা না পেলে ডাক্তার হ্যান্স ক্রেবসের আর কোষীয় শ্বসনের দ্বিতীয় ধাপ আবিষ্কার করা হতো না ইংলন্ডে এসে! জীবনবিজ্ঞান পিছিয়ে যেত হয়তো, হয়তো কেউ না কেউ আবিষ্কার করতেন, কিন্তু ডাঃ ক্রেবসের মতন তৈরী মনন কি পাওয়া যেত? আর কে না জানে, তৈরী মনই সুযোগের সদ্ব্যবহারে সক্ষম।

আজ্ঞে ঠিকই ধরেছেন মশাই, এই সাইকেলটা ডাঃ হ্যান্স ক্রেবসের, ক্রেবস সাইকেল! সবার ইস্কুলেই ছিল, তবে উঠোনে নয়, জীবনবিজ্ঞানের বইতে, শ্বসনের চ্যাপ্টারে। সবাই অল্পবিস্তর চড়েছেন, এখন হয়তো ছানাপোনাদের চড়াচ্ছেন। আজ ডাক্তারবাবুর জন্মদিন কি না, বেঁচে থাকলে আজ তাঁর একশো আঠারো বছর বয়স হতো, তাই বললাম, নমস্কার, চলি তাহলে, আবার দেখা হবে। ক্রিং ক্রিং।

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment