Sunday 19 August 2018

প্যাঁচালো কান্ড

প্যাঁচালো কান্ড

(স্বীকারোক্তিঃ পদার্থবিদ তথা দার্শনিক আরউইন শ্রোয়েডিংগারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধার্ঘ্য মাত্র, পদার্থবিদ্যার গুরুগম্ভীর পুঙ্খনাপুঙ্খ ব্যাখ্যার আঘাত বাঁচিয়ে কেবল উপরস্তরের ভাসা ভাসা মাখনটুকু পরিবেশিত হল।)

কল্পনা কয়, গল্প না হয় একটুও নেই সত্যিটাতে,
কিন্তু ভেবে বলতো দেখি, এমন আসে কল্পনাতে?
অবস্থারা ঠ্যাং জড়িয়ে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে,
এম্নিতরো “রসিকতা” কোয়ান্টামই করতে পারে!
ঢাকনা খুলে যেই দেখেছিস তোর হুলোটা জ্যান্ত বেঁচে,
কেমন করে জানতে পেরে দূরের বেড়াল ঠিক টেঁসেচে!
তুই ভেবেছিস, গাঁজাখুরি! খেয়াল খুশীর তত্ত্ব যতো!!
তা নয়, তা নয়, অ্যাপ্লিকেশান, দেখতে পাবি সময় মতো।
ধীরে ধীরে পন্ডিতেরা পাকাচ্ছে হাত এ বিদ্যাতে,
ক্রিপ্টোগ্রাফি, কম্পিউটিং, ঋদ্ধ হয়ে উঠবে জাতে।
তখন তোরা মান্থলি কাটিস, বসবি চড়ে--নিমেষ-যানে,
সময় ছাড়াই পৌঁছে যাবি, কোয়ান্টেলিপোর্টেশানে।

একথা সকলেই অল্পবিস্তর জানেন যে “কোয়ান্টামম্ ক্লাসিকালম্ নৈব তুল্যং কদাচন”। সেই কোয়ান্টামীয় অদ্ভূতুড়ে কান্ডের সম্ভাব্য সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হল ‘শ্রোডিংগারের বেড়াল’ নামক চিন্তা-পরীক্ষা (Thought-experiment)। একজন পদার্থবিদ, যিনি বেড়ালদের খুব একটা বেশি পছন্দ করেন না, তিনি একটা বাক্সের মধ্যে একখানা বেড়াল রেখে দিলেন। বেড়ালটার সঙ্গী হিসেবে বাক্সে রাখা আছে একপিস মারাত্মক বোমা, আজ্ঞে হ্যাঁ, কিংবা কোন প্রাণঘাতী জিনিস ধরুন, যেটা ফাটার চান্স ফিফটি ফিফটি, বাক্স বন্ধ থাকা অবস্থায়। এর মানে হল এই যে, বাক্স যতক্ষণ না খুলছি, ততক্ষণ জানার কোন উপায় নেই যে বোমাটা ফেটেছে না ফাটে নি! অর্থাত্, বেড়ালটা পটল তুলেছে না কি তোলে নি। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার ভাষায় আমরা বলতে পারি, আমাদের বাক্স খুলে দেখার আগে, বেড়ালটা ছিল জ্যান্ত আর মরা এই দুই অবস্থার মিক্চার! দুই অবস্থা যেন প্যাঁচ মেরে একটা আরেকটায় ঢুকে আছে। ঠিক এরকমই ঘটে কোয়ান্টাম দুনিয়াতে। যেমন পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে পাক খাওয়া ইলেকট্রনের কথাই ধরা যাক। আসলে কিন্তু ইলেকট্রনেরা ওরকম পাক টাক কিছুই খাচ্ছে না, তারা আসলে ভেতরের ফাঁকা জায়গাটার সবটাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঘের মত। সবটা একসাথে, একই সময়ে। কিছু জায়গায় থাকার সম্ভাবনা বেশি, কিছু জায়গায় কম। কোন এক মুহূর্তে সেটা কোনখানে আছে সেটা জানতে হলে আগে আমাদের পরমাণু নামক বাক্সটার ঢাকনা খুলে বিশেষ কোন যন্ত্র দিয়ে তার অবস্থান “মাপতে” হবে! (যদিও মাপামাপির ব্যাপারটা ডেঞ্জারাস এসব ছোট জিনিসের ক্ষেত্রে, কারণ এরা হল আপিসের কর্মঠ কর্মীদের মতো, তাঁদের ভালোমানুষী টেস্ট করতে বারবার যদি আমবাঙালিদের মত তাঁদের “কাঠি” করেন, তাঁদের স্বভাব যেমন পরিবর্তন হতে বাধ্য, তেমনি কোয়ান্টাম দুনিয়ায় একটা ধর্ম ঠিকঠাক করে মাপতে গেলে অন্য ধর্মটা বেগড়বাঁই করে বসে!) ঠিক ওই বেড়ালের পরীক্ষার মত, অবস্থান মাপার আগে অব্দি ইলেকট্রন সর্বত্র বিরাজ করতে পারে, জ্যান্ত ও মরার মিক্চারের মত।

এই চিন্তা-পরীক্ষা থেকেই কোয়ান্টাম এনট্যাংগলমেন্ট (entanglement) বা কোয়ান্টাম প্যাঁচ ধারণার উত্পত্তি। ধরা যাক একটা বাক্সে একটা বেড়ালের বদলে দুটো বাক্সে দুখানা বেড়াল আছে। আগের মত ফিফটি ফিফটি ফাটার চান্সওয়ালা বোমা রেখে পরীক্ষাটা রিপিট করা হল। সবাই বুঝতেই পারছেন যে এবার চারজোড়া অবস্থার প্যাঁচ তৈরী হতে পারে:

প্রথমতঃ দুটো বেড়ালই জ্যান্ত
দ্বিতীয়তঃ দুটো বেড়ালই মৃত
তৃতীয়তঃ ডানদিকেরটা জ্যান্ত, বাঁ দিকেরটা মৃত
চতুর্থতঃ ডানদিকেরটা মৃত, বাঁ দিকেরটা জ্যান্ত

এইবার ধরুন কোনভাবে প্রথম আর দ্বিতীয় সম্ভাবনাকে বাদ দিতে পারা গেল। বাকি যে দুজোড়া প্যাঁচ থাকলো পড়ে, তারা হল একটায় মরা হলে অন্যটা জ্যান্ত আর একটায় জ্যান্ত তো অন্যটায় মরা! কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার ভাষা অনুযায়ী বেড়ালদুটোর অবস্থা হয়ে গেছে এনট্যাংগলড্। যদিও সমস্যা হল, কোন বেড়ালটা বাঁচবে আর কোনটা মরবে, তা আগে থেকে জানার কোন উপায় নেই। কিন্তু এটা ধ্রুব সত্য যে একটা বাঁচলে অন্যটা মরবে। ঠিক এইখানে পরীক্ষাটা হেড টেলের টসিং থেকে আলাদা, কারণ সেক্ষেত্রে আপনি আগে থেকেই জানেন মুদ্রার কোনদিকটা হেড, কোনদিকটা টেল। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই যে ডানদিকের বাক্সটাকে আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সিতে আর বাঁদিকের বাক্সটাকে ব্রম্ভান্ডের সর্বশেষ গ্যালাক্সিতে নিয়ে গিয়ে ঢাকনা খুললেও একই ফলাফল বেরবে, অর্থাত্, একটায় জ্যান্ত হলে অন্যটায় মরা বেড়াল দেখতে পাবো। বেড়াল দুটোর মত এই আচরণ কোয়ান্টাম দুনিয়ায় ইলেকট্রন কিংবা ফোটনের ক্ষেত্রে ভালোমত পরীক্ষাসমেত প্রমাণিত হয়েছে। তবে একটা এনট্যাংগলড্ বেড়াল ওরফে অবপারমাণবিক কণা কিভাবে অন্যটার অবস্থা সম্পর্কে তথ্য জানতে পারে তত্ক্ষণাত্, সেটার মৌলিক কারণ খোঁজার চেষ্টা এখনো চলছে। অবশ্য এখনই এরকম হলফ করে বলা যায় না, যে পুঁটির শাড়ীতে ফলস্ পার বসানো হয় নি, টাকা দাও, এরকম তথ্য পুঁটির মা আলোর থেকেও বেশী বেগে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ থেকে অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথে পুঁটির বাবাকে পাঠাতে পারবে কি না! পদার্থবিদ মিচিও কাকু মনে করেন সেরকম না হওয়ার চান্স বেশী। সে যাই হোক তথ্য আদানপ্রদানের এরকম অদ্ভূত তত্ত্ব শুনলেই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের “জুতা আবিষ্কার” কবিতার সেই চামার কুলপতি আর হবুচন্দ্র রাজার মন্ত্রী গোবুচন্দ্রের কথা, পরস্পরের মন কি সত্যি এরকম এনট্যাংগলড্ ছিল নাকি কেবল ফিচলেমো:
“আমারো ছিল মনে,
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।”

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment