Sunday 6 May 2018

অন্তিম পর্ব: সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

      পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া
                          
                           অন্তিম পর্ব

     ‘আলোর ঢেউয়ে উঠলো নেচে মল্লিকা-মালতী’

এক মিটারের দশলক্ষ ভাগের এক ভাগকে বলে মাইক্রোমিটার। সোডিয়াম আর সিজিয়ামের পরমাণুর ভেতরে ব্যবধান ছিল তিন মাইক্রোমিটার! চোখে তো তা নিশ্চয় দেখা যায় না। এই সব কান্ডকারখানা যা ঘটছে, বিজ্ঞানীরা তা দেখছেন আসলে কম্পিউটারের পর্দায় পরমাণুর ছায়া হিসেবে। বাইরে থেকে দেখলে নইলে কেবল আলোটুকু দেখা যাবে! কোন আলো, কিরকম আলো, কোন পরমাণুকে ধরে আছে এসব দেখাতে অনেক রকম আয়না আর লেন্সওয়ালা সেরকম ওস্তাদ যন্তর আছে বটে, তবে সে সব বোঝার জন্য চাই জহুরির চোখ। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তিল তিল করে জমানো হাজার হাজার মানুষের বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতার ফসল সেসব জহুরির মাথায়।

এখন বিক্রিয়া ঘটাতে গেলে পরমাণুদের আগে কাছে নিয়ে আসতে হবে। সোডিয়ামের আলোক চিমটে স্থির রেখে তার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিয়ে আসা হল সিজিয়ামের 976 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোক চিমটেটা। দুটো আলো যখন মিশে গেল, নিভিয়ে দেয়া হল সোডিয়ামের চিমটে। এখন 976 ন্যানোমিটারে দুই পরমাণু রয়েছে আটকে। একই বাড়িতে বউমা সোডিয়াম (Na) আর শাশুড়ি সিজিয়াম (Cs), মিলমিশ হবে কি না সেটা কপালের ব্যাপার, কিন্তু ঠোকাঠুকি?

পরমাণুদের ঠোকাঠুকি হলেই যে তাতে তারা জুড়ে গিয়ে নূতন অণু দেবে তার গ্যারাণ্টি নেই। প্রথমে তো তাদের মাথায় রাখতে হয় ভরবেগ আর শক্তির নিত্যতা সূত্রগুলো তার উপর আবার সঠিক সময়ে, সঠিক মেজাজে না এলে পরমাণুদের মিলমিশ হয় না। না, ক্যাং কুয়েন নি এর কাছে পরমাণুদের খোশমেজাজে আনার জন্য ক্যাডবেরি ছিলো না, ছিলো ফের আরেকরকমের আলো। যে পরমাণু যেরকম আলো খেলে মিনিমাম উত্তেজিত হয়, সেই রকমের আলো দেওয়া হলো তাদের, আর বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বোঝা গেল, একটি অণু জন্ম নিয়েছে বটে! NaCs* স্বাভাবিক নয়, উত্তেজিত অণু, তবে দেখা দিয়ে সে গেছে মিলিয়ে! এর আগে কখনো এরকম সূক্ষ্মভাবে, সরলাকারে, স্রেফ দুটো পরমাণু পাকড়ে একপিস্ অণু তৈরী করা যায় নি। মানুষ এই প্রথম এভাবে অণু তৈরী করতে শিখলো। বা বলা চলে অণু তৈরী নিয়ন্ত্রণ করতে শিখলো। যে জিনিস ভাগ্য বা প্রকৃতির হাতে ছাড়া হয়েছিলো, তার উপরে মানুষের কন্ট্রোল এলো, অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ হলেও। মানুষ এরকম ভাবে অণু তৈরী শিখলে আশা করা যায় আণবিক কম্পিউটার তৈরী করতে বেশী বছর লাগবে না।

সাধারণ কম্পিউটার যে পরিমাণ তথ্য ধরতে পারে তার মূলে থাকে বাইনারি বিট ব্যবস্থা, 0 আর 1 শুধু এই দুই অবস্থা দিয়ে সেটা চলে। পরমাণু, ফোটন বা ইলেকট্রন দিয়ে যখন সেই তথ্য ধরা বা আদানপ্রদানের কাজটা চলে তখন তাদের বলে কিউবিট। কিউবিট শুধু 0 আর 1 নয়, এমনকি তাদের মাঝামাঝি অনেকরকম অবস্থায় থাকতে পারে। কাজেই বিটের সাহায্যে যে পরিমাণ তথ্য জমানো যায়, কিউবিটের মাধ্যমে তার থেকে বহুগুণ বেশী তথ্য ধরবে। মানে অনেক ছোট হয়ে যাবে কম্পিউটিং ব্যবস্থা। কিউবিট ব্যবস্থা কোয়াণ্টাম কম্পিউটারের মূল অস্ত্র। তাই এককভাবে অণু তৈরী করার চেষ্টার পিছনে আসলে আছে সেই অণুকে কিউবিট হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য। ইলেকট্রন বা ফোটনের তুলনায়, একটি অণু কিউবিট হিসেবে অনেক সুবিধাজনক।

বিজ্ঞাপনে ক্যাডবেরির আমেজ ফুরানোর পরে শাশুড়ি বউমার মিলমিশ টিকেছিলো কি না দেখায় নি, তাই বলে বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েন নি-- স্বাভাবিক অবস্থার একটিমাত্র অণু হাতে গরম তৈরী করা যায় কিনা তা জানতে ক্যাং কুয়েন নি এর টিম এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকের ভল্টে উন্নত কোয়ান্টাম পাসওয়ার্ড দিয়ে সুরক্ষিত আপনার টাকাপয়সার জন্য, ভবিষ্যতে, একদিন হয়তো এইসব নিরলস মানুষদের মন থেকে থ্যাংকিউ জানাবেন।

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
@https://chemssb.blogspot.in

2 comments:

  1. দুর্দান্ত! সবকটা পর্ব পড়লাম৷ এককাপ রসায়ণের সঙ্গে তিন চামচ কাব্য মিশিয়ে এমন অসাধারণ রচনা সৃষ্টি করতে পারেন যে শিল্পী, তাকে কুর্নিশ৷

    ReplyDelete
    Replies
    1. পাঠককে অকুন্ঠ "ধন্যযোগ"

      Delete