Friday 4 May 2018

তৃতীয় পর্ব: পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া

  পৃথিবীর সবচেয়ে সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া
                      
                          পর্ব. তিন:
         আলোর চিমটে কিভাবে কাজ করে

                “যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
              আমি তোমায় ছাড়বো না, মা!”

পরমাণু বা অণুর মধ্যে ইলেকট্রন যখন নাচানাচি করে তখন তার থেকে হয় শক্তি বেরোয়, নয় তাতে শক্তি ঢোকে। উল্টোটাও সত্য। মানে শক্তি ঢোকা বেরনো হলে ইলেকট্রন নাচানাচি করে। যাই হোক, যদি চার্জওয়ালা ইলেকট্রন নাচে তো তার আশেপাশে থাকা ইলেকট্রিক অঞ্চলটাও নাচতে থাকবে আর সেই নিয়মে তার সাথে নব্বই ডিগ্রি কোণে একটা চৌম্বক জায়গাও তৈরী হয়ে নাচতে থাকবে ম্যাক্সওয়েল সাহেবের কথা মেনে। এইরকম নাচতে থাকা ইলেকট্রন যখন শক্তি ছাড়ে, তখনো ওই ছেড়ে দেয়া শক্তি, ওই দুই ইলেকট্রিক আর চৌম্বক অঞ্চলদের বয়ে নিয়ে চলে! এইরকম শক্তিকে আমরা বলি-- আলো। শক্তির নেই ওজন, নেই আধান, তবু কি অদ্ভূত, ইলেকট্রিক আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা অঞ্চল বা ক্ষেত্র তাকে ছাড়তে চায় না, সত্যিকারের শক্তি উপাসক! শক্তির ঢেউ যদি x অক্ষ বরাবর ছোটে, নাচতে থাকা ইলেকট্রিক ক্ষেত্র থাকে y বরাবর আর চৌম্বক ক্ষেত্র z বরাবর।

আলোর এই ইলেকট্রিক ক্ষেত্রের গুণেই পরমাণুদের ধরতে পারি আমরা। বস্তুত, যে জিনিসে চার্জ থাকবে + বা -, তাদের আলো ধরতে ওস্তাদ। আয়ন ধরা খুব সোজা শক্তিশালী আলো দিয়ে। তবে দুটো লেজার আলোকে অভিসারী করতে হবে ভালো লেন্স দিয়ে আর তারা মিলবে যেখানে মানে ফোকাস পয়েন্ট যেটা ওইটে হলো আলোক চিমটের আগা। এখন, পরমাণুতে আছে দুরকম চার্জ, সমান সমান। আলোর ইলেকট্রিক ফিল্ডের বিকর্ষণে পরমাণুর ইলেকট্রন যাবে একদিকে সরে। আর পরমাণুর নিউক্লিয়াস এগিয়ে আসবে ইলেকট্রিক ফিল্ডের টানে! অর্থাত্ একটু আগের সুন্দর ফুটবলের মতো পরমাণুর গঠনটা যাবে ধেবড়ে। একটু আগেও যেটা ছিল নিস্তড়িত্ এখন সেটাই হয়ে যাবে একটা দ্বিমেরু বিশিষ্ট চুম্বক বা বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘ডাইপোল’! বড়ো চুম্বকের চারপাশে যেমন অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্র থাকে, যার কাছে একটু লোহার পেরেক আনলেই তাকে সড়াত্ করে টেনে নেয় চুম্বক, এও অনেকটা এরকম। আলোর সাহায্যে জন্ম নেয়া ডাইপোলের নাম-- অপটিক্যাল ডাইপোল।

কিন্তু এখানে আবার আরেকটু মুশকিল আছে! আলো যে পরমাণুকে ইলেকট্রিক ফিল্ড দিয়ে শুধু যে টানছে তা নয়, আলোর ফোটন কণা আবার পরমাণুটাকে ক্রমাগত গুঁতোচ্ছে। ফিল্ড বলছে আয় আয়, ফোটন বলে পালা পালা! যখন এইদুটো বিপরীতমুখী বল একে অন্যকে ব্যালান্স করতে পারবে, তখন শুরু হলো লেজারের ফাঁদে পরমাণুদের আটকে পড়া। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে অপটিক্যাল ডাইপোল ট্র্যাপ। আলোর চিমটে যতভাবে মানুষ কাজে লাগায়, এটা হলো তার একটা পদ্ধতি।

এভাবেই পরমাণুদের হাঁড়ি থেকে শক্তিশালী লেজার ব্যবহার করে তোলা হয়েছিল একটা পরমাণুকে। এটা অনেকটা হাত মুঠো করে বালি তুলে সেই হাত থেকে সব বালি ফেলে আঙুলের ফাঁকে একটিমাত্র বালুকণা রেখে দেবার মতো ব্যাপার, যতক্ষণ না একটি পরমাণু চিমটের আগায় ধরা যাচ্ছে ততক্ষণ কাজটা চলছিল। ঠিকঠাক মাপ করে তুলতে হতো একটা সিজিয়াম আর একটা সোডিয়াম পরমাণুকে। সিজিয়াম বাঁশকাঠি চালের দানা হলে সোডিয়াম হল গোবিন্দভোগ চালের দানা। কাজেই একরকমের চিমটেতে কাজ চলবে না!

পরমাণু যত বড় হয় তাকে ধেবড়ে ডাইপোল বানাতে আলোর তত কম শক্তি লাগে। এ হিসেবে সোডিয়াম ধরতে বেশি শক্তির আর সিজিয়ামের জন্য কম শক্তির লেজার আলো লাগবে। এখন আলোর ঢেউ গুলোর মধ্যে দূরত্ব কম হলে আলোর শক্তি বেড়ে যায়। সাধারণত, এই দূরত্ব মাপে ন্যানোমিটারে (1 মিটারের 100 কোটি ভাগের 1 ভাগে)! এর বৈজ্ঞানিক নাম তরঙ্গদৈর্ঘ্য। এই কারণে সোডিয়াম পরমাণু ধরতে বেশি শক্তির 700 ন্যানোমিটার আর সিজিয়াম পরমাণু ধরতে কম শক্তির 976 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লেজার আলো ফেলা হল। একটা চিমটেয় সোডিয়াম আর একটা চিমটেয় সিজিয়াম পরমাণু ধরার পরে বিজ্ঞানীরা বন্ধ করে দিলেন ছয়দিক থেকে পড়া লেজারের ঝর্ণাধারা আর চারমুখো সেই চৌম্বক ক্ষেত্রটাকে, পরমাণুর হাঁড়ি, গোদা বাংলায় বলা চলে, ফেটে গেলো! প্রায় বায়ুশূন্য স্থানে ভেসে রইলো সোডিয়াম আর সিজিয়ামের একটি একটি পরমাণু, লেজার চিমটের ডগায়।

শাশুড়ি সিজিয়াম পরমাণু আর বউমা সোডিয়াম পরমাণুর মধ্যে দূরত্ব এখন কত হতে পারে, আন্দাজ?

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment