Thursday 31 May 2018

প্রোটনের পেটের ভেতরের চাপ

                   চাপের ব্যাপার!

কদিন ধরে হেভি চাপ চলছে! এমনিতেই মরার অনেক পরে বুঝেছিলাম মরে গেছি তাই নিয়ে চাপটা ছিলোই। মেঘলা আকাশের মত গুমোট মন নিয়ে গঙ্গার ধারে ঠ্যাং ঝুলিয়ে ভৌতিক বিড়ি ফুঁকছিলাম আর ভাবছিলাম ‘জেবনে আর কিছু হলো না!’

এমনি সময় লোকটা জল থেকে উঠে এলো। ভিজে নয়, শুকনো অবস্থায়। আমি ঘাবড়ে গেছি দেখে বললো - ঘাবড়াও কেন, তুমি তো অলরেডি পটল তুলেছো, এখন তুমি নেই। মানে ভূত, অতীত।

আমি বললাম, তা ঠিক, তবে এখনো ঠিক প্র্যাকটিস হয়নি তো, তাই ভয় লাগে। তা তুমি কী, আমার মতোই নিশ্চয়, নইলে জলে থেকেও এমন শুকনো কেন?

লোকটা একটা পিত্তিজ্বালানো হাসি হেসে বললো, আমি তোমার মতো নই। আমি আছি, মানে মরবো না কোনদিন, গ্যারান্টি। আমি জলেও আছি, বাতাসেও আছি, সূর্যে এমনকি মহাশূন্যেও আছি।

আমি রেগে বললাম, এসব ঢপ বন্ধ করো। যখন বেঁচে ছিলাম, দুটো মাতব্বর এমনি ঢপ দিতো। তাদের কথা বিশ্বেস করে আজ আমার এই দশা। তুমি কি বাবা লোকনাথ?

লোকটা বললো, তা বলতে পারো, আবার প্রোটনও বলতে পারো, জলের অণুর দিব্যি, এইমাত্র একটা অণু ফুটে, ইয়ে মানে, তোমরা যাকে স্বতঃবিয়োজন বলো, তা হয়ে বেরোচ্ছি।

আমি বললাম, বটে? তা তুমি যে প্রোটন তার প্রমাণ কি হে?

লোকটা হাত দুটো উপরে তুলে পা দুটো ছেতড়িয়ে দাঁড়িয়ে বললো, এই দ্যাখো তোমাদের ইনজিরি এইচ অক্ষরের মতো দেখতে লাগে কিনা। আর এই যে মাথার পেছনের টিকি, এইটা আমার প্লাস চার্জ। হলো কিনা!

আমি বললাম, এ বাবা, এতো সরল! তুমিই সেই যে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকো?

লোকটা বললো, হ্যাঁ গো বাঙালির ভূত, হ্যাঁ।

আমি হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বললাম, তুমিই সেই আদিকণা যার সংখ্যা বলে দেয়, মৌলটা কী হবে?

লোকটা গদগদ হয়ে বললো, যা বলেছো ভাগাড়ের ভূত। তারপর কেমন যেন উদাস হয়ে গেলো। বললো, তবে আজকাল জানো কেউ পাত্তা দেয় না। সে রাদারফোর্ড ও আর নেই, সে পরমাণুও আর নেই। তুমিই বলো, আদিকণা হিসেবে আমি কম হলাম কিসে!

আমি সবে ঘাড় নেড়ে তাকে শান্ত করতে যাচ্ছিলাম, এমনি সময় প্রোটন, অথবা প্রোটন নামের লোকটা কেমন একটা করতে থাকলো। পেট ধরে চ্যাঁচাতে লাগলো, আর মাঝে মাঝে কাকে যেন বলতে লাগলো, হতভাগার দল, আমাকে তোরা শান্তিতে থাকতে দিবি না, বাঙালির ভূতের সামনে বেইজ্জত করছিস!

আমি বললাম, পেটে গ্যাস হয় তো ইউনেনজাইম খেলেই পারো।

লোকটা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললো, ইঃ! তোমার যেমন বুদ্ধি! গ্যাস হতে যাবে কি সে! তুমি কোয়ার্কের নাম শোনো নি বুঝি?

আমি বললাম, ইস্কুলে মাস্টার ছিলো না বলে বিজ্ঞানের ক্লাস বন্ধ ছিলো, বাংলার মাস্টার পরমাণুর পেটে কি আছে ওই জানিয়েছিলো। তোমার পেটে কি আছে তা জানার সৌভাগ্য হলো কই!

প্রোটন বললো, ওই যে তুমি আমায় আদিকণা বললে, তাইতে হতভাগাদের প্রেস্টিজে লেগেছে। ওরা তিন পিস্ কোয়ার্ক, আমায় নাকি গড়েছে বলে দাবি করে। উঃ বাবারে! গেলুম গেলুম! আর নাচিস না। হ্যাঁ হ্যাঁ, তোরাই আদিম যুগের কণা, নে হয়েছে?

আমি বললাম, তিনটে কোয়ার্ক? ওদেরকে বাইরে বের করে দাও না।

প্রোটনটা বললো, সে বলা ভারি সোজা। ওরা দুটো এক চরিত্রের আরেকটা আলাদা। তোমাদের পন্ডিতগুলো ছিলো তাই রক্ষে। ওদের দুটোকে নাম দিয়েছে ‘আপ’ কোয়ার্ক। আর একটার নাম ‘ডাউন’ কোয়ার্ক। আমার পেটের বাইরে বার করলে ওদের বুঝতে পারবে না, এমনি চালাক। কেবল আমি বুঝি ব্যাটাদের শয়তানি, উরে বাবারে!

আমি বললাম, ডাক্তার দেখিয়েছো?

প্রোটন বললো, তা আবার নয়? ভালো ডিগ্রিধারী নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট দেখিয়েছি! কি বললো জানো? বলে কি না ওই তিনটে বজ্জাত পেটের ভিতর এমনি আঁটাআঁটি করে বসেছে যে বার করার জো নেই! এতোটাই শক্ত ওদের নিজেদের মধ্যে টান! ওর নাম দিয়েছে নিউক্লীয় বল। আরেক ডাক্তার বলেছে, ওই বল ফল বলে কিছু নেই। কোয়ার্ক আছে, আর ওদের মাঝে আঠার মতো একরকম কণা আছে, যাকে বলে গ্লুওন। অবিশ্যি, অনেক ডাক্তারে ওদের কণা বলে ধরেনা, বুঝলে? কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিক্স বলে একটা ব্যাপার আছে….উরেঃ বাপস্, আর লাফাস নে!

আমি দেখলাম, ব্যাটা পেট ফেটে মরে আর কি! কাজেই যা জানার এই বেলা জেনে নি। জিগ্যেস করলাম, কোয়ার্ক গুলোর নিজেদের মধ্যে এই যে ভয়ানক টান, সেই টানে তো নিজেরাই নিজেদের সাথে ঠোক্কর খেয়ে মিলিয়ে যাবে, তখন তোমার কি হবে ভেবে দেখেছো?

প্রোটন বললো, আরে সেই কথাই তো তোমায় বলতে আসছিলাম, তোমায় মনমরা দেখে! ডাক্তারগুলো এই সন্দেহটা অনেককাল আগে থেকেই করছিলো! টান যদি থাকে, ঠ্যালাও থাকবে, নইলে আমি বাঁচি কিভাবে? আর আমি না বাঁচলে তোমাদের কি হবে গো?

আমি দেখলাম, প্রোটনটা আবার ক্রেডিট নিতে যাচ্ছে! তাই তড়িঘড়ি বললাম, তারপর ঠ্যালার ব্যাপারটা জানা গেলো?

সে বললো, এই তো এবছর মে মাসের মাঝামাঝি, আমেরিকার থমাস জেফারসন ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটার ফেসিলিটি সেন্টারে আমরা গেছিলাম, আমার মতো অনেক হতভাগা প্রোটন পেটে কোয়ার্ক নিয়ে ডাক্তার ভোলকার বার্কার্টের চেম্বারে ভর্তি ছিলো  (doi:10.1038/s41586-018-0060-z)। তো ওরা বেশ জোরালো ইলেকট্রন রশ্মি আমাদের পেটে ফেলে টেলে দেখলো, কোয়ার্কগুলো কেম্নি করে! শেষে ওদের ভরবেগ আর শক্তির কতকগুলো ম্যাপ এঁকে টেকে বললো, চাপের ব্যাপার।

আমি বললাম, চাপের ব্যাপার? মানে?

সে বললো, আমিও এই রকম জিগ্যেস করেছিলুম, বুঝলে, তাতে ওরা গম্ভীর হয়ে বললো, আমার পেটে নাকি দুরকম চাপ! আর এটা নাকি ওরাই প্রথম বের করতে পেরেছে। বিশ্বেস না হয় নেচার পত্রিকায় দেখো, 16ই মে বেরিয়েছে! একটা চাপ ভিতরে ঠেলছে কোয়ার্কদের, ওটা অতোটা ভয়ানক না হলেও যে চাপটা পেটের মধ্যিখানে কাজ করছে, সেটা কোয়ার্কগুলোকে বাইরের দিকে ঠেলছে। এই দুটো চাপ নির্ঘাত ব্যালেন্স করছে, আমি তাই বেঁচে যাচ্ছি! কোয়ার্কগুলো পেটের ভেতরে টিকে থাকছে।

আমি বললাম, এই ব্যাপার! এতে এতো প্রচারের কি আছে হে? মধ্যিখানের এই চাপটা কি আমার মনের চাপের থেকেও বেশী?

প্রোটনটা এই শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে এমন হাসলো যে আমার বিড়িটা নিভে গেলো! হাসি থামিয়ে বললো, তুমি যখন বেঁচে ছিলে, তখন তোমার উপর বাতাসের চাপ কতটা ছিলো জানো?

আমি বললাম, এটা সেভেনের! ওই 10 টু দি পাওয়ার 5 পাস্কালের মতো! মানে একের পিঠে পাঁচটা শূন্য, এক লাখ পাস্কাল, প্রায়।

একটু থেমে বললাম, ইয়ে মানে, সমুদ্রপৃষ্ঠে!

সে বললো, এইটুকু চাপ তোমরা নিতে পারো না বলে তোমাদের গায়ে আবার ফুটো করে বাইরে ভেতরে চাপ সমান করতে হয়েছে! ছোঃ! আর আমি পেটের মধ্যিখানে 10 টু দি পাওয়ার 35 পাস্কাল চাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, উইদাউট ফুটো!

আমি স্রেফ হাঁ। প্রোটনটা বলে কি? 10 টু দি পাওয়ার 35 পাস্কাল মানে একের পিঠে পঁয়তিরিশটা শূন্য! সে যে ব্রম্ভাণ্ডের সবথেকে ঘনীভূত বস্তু নিউট্রন তারকার পেটের চাপের থেকেও দশ গুণ বেশী চাপ!!

আমি বললাম, এ-তো চা-প! কিভাবে নাও ভাই?

সে বললো, ওইটাই তো বলতে আসছিলাম, ভিতরে এতো চাপ নিয়েও আমি যদি পজিটিভ থাকতে পারি তবে তুমি, যে কিনা আমাকে দিয়েই তৈরী, সে কেন চাপের মুখে মনমরা, প্রিয় ভাগাড়ের ভূত? বি পজিটিভ, লাইক মি, এই বলে নাচতে লাগলো!

আমি বললাম, ইসস্! ডাক্তার বার্কার্ট কেন আর কদিন আগে চাপের ব্যাপারটা জানালেন না! তাহলে চপের দোকানটা দিয়ে সংসারটা টানতে পারতাম! এইসব ভাবছি এমনি সময় দেখি জল থেকে একটা মোটা সোটা হাইড্রোক্সিল আয়ন উঠে ইলেকট্রনিক জিভ বার করে সুড়ুত্ করে প্রোটন টাকে টেনে নিয়ে গিলে ফেললো!

তোমরাই বলো, এসব চাপের ব্যাপার কি না!

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

1 comment: