Sunday 22 April 2018

পরমাণুর কথা

পরমাণুর ভালো বাসা

পরমাণুর ভিতরের অধিকাংশ স্থানই ফাঁকা, আর এর ঠিক মধ্যিখানে দলা পাকিয়ে আছে নিউক্লিয়াস। তাকে ঘিরে আছে ইলেকট্রনের মেঘ। এ দুয়ের মাঝে অনেকটা জায়গাই স্রেফ্ শূন্য।

দুটো পরমাণু একে অন্যকে কতটা ভালোবাসলে একটার ভেতরে আরেকটা সেঁধিয়ে যেতে পারে? নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকলে না হয় হলো রাসায়নিক বন্ধন, 'অন্যায়' করে হলে আয়নীয়, আর 'সম্ ঝোতা' করে হলে সমযোজী, কিন্তু ওই অব্দিই। বেশী কাছে এগোলে ইলেকট্রনের মেঘগুলো একে অন্যকে ঠেলাঠেলি করতে শুরু করবে। ধাতব বন্ধনী অবশ্য একটু উদার। সেখানে ইলেকট্রন মেঘগুলো বড়ো আলগা, নিজেরা হাত ধরাধরি করে ইলেকট্রনের সমুদ্র বানায়, তাতে ভেসে থাকে সেতুবন্ধনের পাথরের মতো ধনাত্মক আয়নগুলো। এসবই সাধারণ চাপ আর তাপমাত্রার ধারণা।

একটু অসাধারণ তাপমাত্রায় আসা যাক। বজ্রপাতের সময় বাতাসের তাপমাত্রা হয়ে যায় প্রায় 28000 কেলভিন। ওই ভয়ানক গরমে বাতাসের অণু পরমাণু থেকে ইলেকট্রন খুলে বেরিয়ে আসে, পরমাণু হয়ে যায় আয়ন, বাতাস হয়ে যায় আয়নিত। এমনি বাতাসের থেকে এর আচরণ আলাদা। এটা হলো পদার্থের চার নম্বর অবস্থা, প্লাজমা।

তাপমাত্রা কমালে? পরম শূন্য বা জিরো কেলভিনের  কাছে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। 1995 সালে রুবিডিয়াম নামে এক ধাতুকে গ্যাসীয় অবস্থায় নিয়ে গিয়ে তার উষ্ণতা 0.00000017 কেলভিন পর্যন্ত নামানো হয়েছিলো। এতো কম তাপমাত্রায় পরমাণুগুলো বোসন কণার মতো আচরণ করে। বোসন কণা অনেকটা শেয়ালদের মতো। সব শেয়ালের যেমন এক রা, তেমনি একগাদা বোসনের সবাই একই শক্তিমাত্রায় থাকতে পারে, একই কোয়ান্টামীয় বাসা শেয়ার করতে পারে। মোট কথা একেবারে গলায় গলায় ভাব! যদি ওদের সাথে প্রতিদিন বাজার করতে গিয়ে দেখা হতো, দেখতাম বাবা মা মাসী মেসো, পিসী, পিসে, মামা কাকা সবাই একরকম দেখতে, কারো থেকে কাউকে আলাদা করে চেনার জো নেই। পরমাণু যতক্ষণ সাধারণ ভাবে ছিলো, ততক্ষণ এমনটি হয়নি। জিরো কেলভিনের ঠ্যালায় পড়ে সবাই যেন অনেক দেহ, এক প্রাণ। 'একই সূত্রে বাঁধিয়াছে সহস্র জীবন'। দেখা গেলো, প্রায় 2000 খানা রুবিডিয়াম পরমাণু এই অবস্থায় ভালোবাসাবাসি করে থাকতে পারে। এরা আর সাধারণ আলাদা আলাদা পরমাণু নেই, সৃষ্টি হয়ে গেছে বোসনীয় মহাপরমাণু! নিঃসন্দেহে এটাও পদার্থের আরেকটা নূতন অবস্থা। একে বলা হয় 'বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা', পদার্থের পঞ্চম অবস্থা।

কিন্তু এখনো পরমাণুরা একে অন্যকে এতোটাও ভালোবাসতে পারে নি যে একে অন্যের ভিতরে হৃদয়ে ঢুকে যাবে! স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে, তাহলে একটা পরমাণুকে আকারে অস্বাভাবিক বড়ো হতে হবে। তবে ওর মধ্যে আরেকটা পরমাণু সেঁধোতে পারবে। কিন্তু তাইবা হবে কি করে? পরমাণুদের পাম্প দিয়ে ফোলানো যায়? যায় বটে, তবে শক্তি পাম্প করতে হবে। শক্তি দিয়ে পরমাণুকে খেপিয়ে দিলে ইলেকট্রনের মেঘেরা ছটফট করতে করতে নিউক্লিয়াস থেকে বেশ দূরে সরতে পারে। পরমাণুর সীমানা তো তদ্দুরই যদ্দুর ইলেকট্রন মেঘ বিস্তৃত। খ্যাপা পরমাণুতে ইলেকট্রনমেঘ যত নিউক্লিয়াস থেকে দূরে ছড়িয়ে যাবে ততই পরমাণুর আকার বাড়বে। বেশী খেপালে আবার ইলেকট্রন বিরক্ত হয়ে পাকাপাকি ভাবে পালাবে। তাই সাবধান! পরমাণু ফুলুক, কিন্তু যেন না ফাটে। ফাটলেই আয়ন হয়ে যাবে! পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ইলেকট্রনগুলোকে নিউক্লিয়াস থেকে সরালে সবচাইতে বেশী প্রায় কয়েকশো ন্যানোমিটার (0.000000001 মিটার) ফাঁকা জায়গা মেলে। তার মধ্যে প্রায় 500 খানা সবচেয়ে ছোটো যে পরমাণু,হাইড্রোজেন, তারা ধরে যাবে! এইরকম অস্বাভাবিক ফুলকো পরমাণুকে বলে রিডবার্গ পরমাণু। রিডবার্গ পরমাণুদের আচার আচরণ স্বাভাবিক পরমাণুদের মতো যে হবে না তা বলাই বাহুল্য! এইরকম পরমাণুদের তৈরী করার সবচেয়ে আধুনিক উপায় হলো নির্দিষ্ট শক্তির লেজার রশ্মি ছোঁড়া। লেজারের শক্তি থেকে পরমাণু শক্তি নিয়ে খেপে ফুলে উঠবে। জন্ম হবে রিডবার্গ পরমাণুর।

আমেরিকার টেক্সাসে, রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটু অন্যরকম ভাবে রিডবার্গ পরমাণু তৈরী করা হলো। 2018 সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বিজ্ঞানীরা জানালেন তারা কী কী করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথমে স্ট্রনসিয়াম ধাতুর পরমাণুদের জিরো কেলভিনের খুব কাছাকাছি বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থায় নিয়ে আসা হলো। অর্থাত্ পরমাণু গুলো এখন আর আলাদা আলাদা পরমাণু হিসেবে কাজ করছে না,
ভালোবাসায় তারা মাখোমাখো হয়ে একটাই মহাপরমাণু বা সুপারঅ্যাটম হয়ে গেছে। খুব কাছাকাছি ঘন হয়ে বসেছে তারা। এমনি সময় নির্দিষ্ট শক্তির লেজার রশ্মি ফায়ার করা হলো। মহাপরমাণুর জোটের ভিতরে ধরাযাক একটি পরমাণু রিডবার্গ পরমাণু হয়ে ফুলতে লাগলো। মোটা বন্ধুর ঘামের গন্ধে বাকিদের পালানোর কথা! কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছে যে, যাবে কোথায়! বর্ণালীবিক্ষণ যন্ত্র জানালো বিজ্ঞানীদের, ফুলে ওঠা রিডবার্গ পরমাণুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে অন্তত 170 টার মতো স্ট্রনসিয়ামের পরমাণু, বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা থেকে! এই পরিস্থিতি যে হতে পারে তা কম্পিউটার-নির্ভর তাত্ত্বিক গণনায় আগেই জানা গেছিলো 2016 সালে। এখন প্রমাণও পাওয়া গেলো।

শেষমেষ তাহলে পরমাণুর পেটেও পরমাণু দলবল নিয়ে ঢুকে পড়লো! এখন তাহলে অবস্থাটা কী? স্বাভাবিকের থেকে বেশী ফোলা একটা পরমাণু, তার মধ্যে একটা নিউক্লিয়াস আছে, আর সেই নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুরছে শুধু ইলেকট্রনগুলো নয়, 170 খানা এমনি পরমাণু! মা পরমাণুর পেটের ছানা পরমাণু গুলোর সাথে একরকম পারমাণবিক বন্ধনীও আছে। এই আনকোরা অদ্ভূত বন্ধনীর নাম দেওয়া হয়েছে 'রিডবার্গ পোলারন'। পদার্থের অবস্থার লিস্টিতে নবতম সংযোজন এই অতিশীতল অবস্থা।

মহামানবেরা অনেক আগেই বলে গেছেন, ভালোবাসায় সব হয়!

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment