Sunday 22 April 2018

ফোটনের ফাঁদে

             লেজারের ঝর্ণাধারায়

বিলম্বিত শুভ নববর্ষ!

আলো বাড়ছে, গরম বাড়ছে। বৈশাখ শুরু হলো। সূর্যের আলো মাথা গরম করে দিচ্ছে আমাদের। আলো আর তাপ যেন দুই বন্ধু। যেখানে আলো পড়ে সেখান গরম হতে শুরু করে। আবার কখনো কখনো তাপ দিতে দিতে জিনিস জ্বলে গিয়ে আলো বিকিরণ করতে শুরু করে। আলো আবার অনেকরকম, সব আলোকে মানুষ চোখে দেখতে পায় না। তবে যন্ত্রে ধরতে পারে। সব আলোই একরকমের শক্তি। জানলে আশ্চর্য লাগবে, তাপও একরকমের আলো। আমাদের দেহ থেকে এই বেরোনো তাপ বা আলো কুকুর বেড়ালরা অন্ধকারে দেখতে পায়।

আলোর শক্তি দিয়ে সাধারণতঃ জিনিস বা জিনিসের কণাগুলোকে খ্যাপানোই হয়। আলো ভূত বা পদার্থ নয় বরং বলা যায় অদ্ভূত। কখনো আলোকে ভরহীন কণার স্রোত বলে কল্পনা করা যায়। কখনো বলা হয় আলোর শক্তি ঢেউ হয়ে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। ঢেউ বড়ো ছোট হতে পারে। ঢেউগুলো যত কাছাকাছি থাকে শক্তি তত বেশী হয়। আর দূরে দূরে থাকলে শক্তি কম। ঘনঘন আসা ঢেউ এর ধাক্কা কেমন তা সমুদ্রে স্নান করা লোক মাত্রেই জানবেন। আলোর সব ঢেউ আবার একতল দিয়ে চলে না। কেউ উপরে কেউ নীচে বিভিন্ন বেগে ছোটে। সাধারণ আলোতে এইরকম ঢেউ থাকে। একই মাপের একই বেগে চলা ঢেউ একরঙের আলো তৈরী করে, যদিও তারা একই তলে থাকে না। সেইজন্য এইরকম আলো ছড়িয়ে পড়ে বেশীদূর যেতে পারে না। যদি এইরকম আলোর ঢেউকে জোর করে একইতলে একসাথে চালানো যায় তবে সেটা যে শক্তিশালী হবে সন্দেহ নেই। একতা আছে বলেই ওরা অনেকদূর যেতে পারে। এরকম আলোর নাম লেজার (Light Amplified Stimulated Emission of Radiation, LASER) রশ্মি, মাত্র 0.001 মিলিমিটার চওড়া।

গোয়েন্দা গল্পে এবং সিনেমায় লেজার আলোর ব্যবহার দেখলে তাকে বেশ মারকুটে বলেই মনে হয়। জেমস্ বন্ড লেজার দিয়ে লোহার বন্ধ দরজা কেটে ফেললেন। নায়িকার পোষা বেড়ালের লেজ কেটে দিলো লেজার। লেজার দিয়ে সুরক্ষিত ব্যাঙ্কের ভল্ট। লেজার বোমা প্লেন থেকে ছুটে এসে ধ্বংস করলো বাড়ী। বাস্তবে প্রচুর শক্তিশালী লেজার দিয়ে ঝালাই পর্যন্ত করা যায়। লেজার মানেই সবসময় জিনিস পুড়িয়ে দেবে এমন কিন্তু নয়। শক্তিশালী লেজার পদার্থকে ঠান্ডাও করে দিতে পারে।
ঠিক কতটা ঠান্ডা জানতে গেলে আগে জানতে হবে ঠান্ডা কী?

ঠান্ডা মানে তাপের অভাব। তাপ কিরকম?

জিনিস যা দিয়ে তৈরী সেইসব অণুপরমাণু কোনো সময় স্থির নেই, জিনিস যতই স্থির হোকনা কেন। ভেতর ভেতর এই যে ছোটাছুটি চলছে, ওটাই বাইরে তাপ হিসেবে ধরা দেয়। ছোটাছুটি যত বেশী, তাপের মাত্রা তত বেশী। সূর্যের পিঠের তাপমাত্রা 6000 কেলভিন, লোহা  1800 কেলভিনে গলে। 373 কেলভিনে জল ফোটে, 303 কেলভিন আমাদের ঘরের উষ্ণতা। জল বরফ হয় 273 কেলভিনে। 200 কেলভিনে কার্বন ডাই অক্সাইড বরফ হয়, 50 কেলভিন নামার আগে বাতাস তরল হয়ে যায়। মহাকাশের গড় তাপমাত্রা 3 কেলভিন।

প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাপমাত্রা 0 কেলভিনের কাছে আরো কাছে নিয়ে যেতে। লেজার রশ্মির সাহায্যে 0.000001 কেলভিন থেকে 0.000000001 কেলভিন তাপমাত্রার সৃষ্টি করা যায়। ক্ষার ধাতুর গ্যাসগুলো এই কাজের জন্য সবথেকে উপযোগী। লিথিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, রুবিডিয়াম, সিজিয়াম, ফ্রান্সিয়াম -- এই সাতটা মৌল হলো রসায়নের ভাষায় ক্ষার ধাতু। ফ্রান্সিয়াম তেজস্ক্রিয়, তাই ওকে না ঘাটানোই ভালো। তা বাদে বাকি ধাতুগুলো গ্যাসীয় অবস্থায় নিয়ে গিয়ে দেখা যায় পরমাণু গুলো নিজেদের মতো স্বাধীন ভাবে ছোটাছুটি করছে। সোজা নিয়ম হলো, গ্যাসের তাপমাত্রা কমাতে গেলে পরমাণুদের ছোটাছুটি থামাতে হবে। তার জন্য ধাতব গ্যাসটাকে এমন একটা কাচের ঘরে আটকাতে হবে যেটা নিঁখুতভাবে বায়ুশূন্য।

ধরা যাক ওই ঘরে সোডিয়াম বাষ্প ভর্তি। ভেতরের চাপ অনেক অনেক কম। তাই সোডিয়ামের নিস্তড়িত্ পরমাণু গুলো একটা আরেকটার থেকে অনেক দূরে দূরে নিজের মতো করে ছুটছে। আমরা ধরলাম একটা পরমাণুকে কোন দিব্যচোখ দিয়ে। দেখছি সেটা ডানদিকে ছুটছে। আমি ডান দিক থেকে কণাটার ঠিক মুখোমুখি একটা লেজার রশ্মি চালিয়ে দিলাম। লেজারটার শক্তি এমন যে তা পরমাণু শোষণ করতে পারে না।

পরমাণু খুব নিয়মনিষ্ঠ কণা। যে কোন শক্তি মাত্রা পেলেই সে শোষণ করবে বা খাবে এমনটা নয়। পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকে ইলেকট্রন। বাইরে থেকে শক্তি পেলে ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে বেশী শক্তির কক্ষে চলে আসে। উত্তেজিত হবার জন্য যতটুকু শক্তি প্রয়োজন ততটুকুই পরমাণু নেবে। প্রতিটা পরমাণুতে হালকাভাবে আটকানো ইলেকট্রন এক বা একের বেশী আছে। সেইমতো প্রতিটি পরমাণু উত্তেজিত হতে একটা  ন্যূনতম শক্তি লাগে। এরথেকে একটু খানি কম শক্তির আলো পরমাণুতে পড়লেও পরমাণু সে আলোর ফোটনকণা খায় না। তবে ফোটনের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে ওর বেগ কমে। কিন্তু পরমাণুটা এখনো ওই ডানদিকে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলো তার সাপেক্ষে লেজারের ফোটনের শক্তি যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ডানদিক থেকে মুখোমুখি ছুটে আসা ফোটনগুলো যেন হর্ন বাজানো (শক্তি) অ্যাম্বুলেন্স, যত কাছে যাচ্ছে হর্ন বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। পরমাণু ভাবে, এ ডপলার সাহেবের কৃপা। ডপলার এফেক্ট। ফোটনের শক্তি বাড়ছে মানে পরমাণু একসময় তাকে খেতে পারে, যেটা আগে হচ্ছিলো না। পরমাণু ছোটাছুটি করার আগ্রহ হারালো, ডানদিকে গেলেই খাবার মতো ফোটন পাওয়া যায় যখন তখন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে কী লাভ! এদিকে উল্টোদিক থেকে আসা ফোটন গিললে পরমাণুর বেগ যে কমবে সেটা ফুটবলার মাত্রই বোঝেন। বেশী জোরে নিজে ছুটলে বলটা ফসকাবে। কাজেই পরমাণুর বেগ কমতে হলো। পরমাণুর অস্থিরতা যেন কমছে! আবার সঠিক শক্তির ফোটন গিললে পরমাণুর ইলেকট্রন উত্তেজিত হবেই। বেশীক্ষণ এরকম অবস্থায় না থেকে পরমাণু সেই ফোটন ছেড়ে স্বাভাবিক হতে চাইবে। ফোটন বেরোনোর সময় পরমাণু উল্টোদিকে ধাক্কা খায়, ঠিক গুলি বেরোলে বন্দুক যেমন সরে আসে। এ সময় পরমাণুর অস্থির হয়ে যাবার কথা। কিন্তু ফোটন বেরনোর দিকের যেহেতু কোনো ঠিক নেই, তাই সবদিকের সম্ভাব্য ধাক্কা একে অন্যকে কাটাকুটি করে দেয়। পরমাণুর অস্থিরতা বাড়তে দেয় না।

কিন্তু পরমাণুটা যদি খালি ডান দিকে না চলে? তবে উপায়?

বেশ, তাহলে বাঁদিক ডানদিক সামনে পেছনে উপরে নীচে x y z তিনটে অক্ষ বরাবর লেজার রশ্মি দিয়ে আক্রমণ শানাও। পরমাণু আর ছোটাছুটি করতে পারবে না। আলোকীয় ফাঁদের পাল্লায় পড়ে পরমাণু প্রায় স্থির হয়ে পড়েছে এখন। তাপমাত্রা নামছে হু হু করে। লেজার দিয়ে মাইক্রোকেলভিন তাপমাত্রায় শীতলীকরণের এই পদ্ধতি আবিষ্কারকে 1997 সালে মানুষ সম্মান জানিয়েছে পদার্থবিদ্যায় নোবেল দিয়ে। কেন, সে গল্পের জন্য তো পুরো নতুন বছর রইলোই।

এক কেলভিনের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত ঠান্ডা করা পরমাণুপুঞ্জ আটকে আছে আলো দিয়ে বানানো এক চিটেগুড়ে, লেজারের ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে শীতল করা কী একেই বলে?

©শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

1 comment:

  1. চমৎকার লিখেছেন স্যার।সহজ ভাষায় এরকম লেখা বিজ্ঞানের প্রতি সবার ভালোবাসা তৈরি করবে।

    ReplyDelete