Saturday 9 June 2018

মুক্তির দামঃ তৃতীয় পর্ব

               মুক্তির দামঃ তৃতীয় পর্ব

“স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার, দ্রবণে সাঁতার কাটা আমরা অর্জন করবোই, বন্ধুরা। ইলেকট্রনের দল পালাচ্ছে! টান পড়েছে আজ ওদের শক্তিতে। এই তো সময়! বেরিয়ে পড়ো আমার স্নেহের ভাইবোনেরা ও বিষণ্ন হতাশ কিউপ্রিকের বীর যোদ্ধারা! গলিয়ে দাও এই তাম্রকপাট!” ভাঙন লেগেছিলো তামার অ্যানোডে, পজিটিভ তড়িত্ যার উপরে ভর করেছিলো আমার ব্যাটারির দাক্ষিণ্যে, আর সেই হট্টমেলায় দাঁড়িয়ে কিউপ্রিক জাতিকে উদ্বুদ্ধ করছিলো ভেতরের সারিতে থাকা একটা কিউপ্রিক আয়ন।

তামার পাতের যে অংশটা এখনো অব্দি কপার সালফেট দ্রবণে ডোবে নি, সেইখান থেকে চেঁচিয়ে বললো এক বুড়ো কিউপ্রিক, “নীল রঙে ডুবে আছো, তাই অমন কথা বলতে পারছো, আমাদের মতো শুকনো থাকতে তো বুঝতে এদিককার অবস্থা। তোমরা কি ভাবছো, ইলুরা ফিরে আসবে না? একই শয়তান ইলু ফিরে আসবে, তবে তাম্রনীতি নয় অন্য কোন নীতির দলে ভিড়ে, ওরা আসবেই মূর্খের দল! স্বাধীনতার এ চেষ্টা বৃথা।”

“বৃথা ভয় পাচ্ছো খুড়ো, যখন স্বাধীনতার স্বাদ পাবে, মুক্ত মনে দ্রবণে সাঁতার কাটবে, তখন তোমার ভয় ভাঙবে, যেমন দক্ষিণ সাগরে পাঁচিল ভাঙছে আর গলছে!”

“না না, দাসত্ব আমাদের নিউক্লিয়াসে, তোমরা কি ভাবো, এই মুক্তির কোন দাম নেই? মুক্তি বলে কিছু হয় না! জীবনে এতবার জারিত আর বিজারিত হলাম, আর নড়তে চড়তে মন চায় না।” কিউপ্রিকদের বয়স বাড়ে না বা কমে না, তবুও আমার মনে হল এই আয়নটা বোধহয় বুড়ো, সেই সব বুড়োর মত যারা পরিবর্তিত হতে ভয় পায়, পরিবর্তনের পরেও যে পরিবর্তন হওয়াই জগতের নিয়ম তা ভুলে যায়!

আমি যেন সঞ্জয় হয়ে গেছি! মহাভারতের সঞ্জয় টেলিভিসনের মতো বর পেয়েছিলো, আমাকে আমার পুঁচকে ছাত্রী মাইক্রো, ন্যানো কিংবা ফেমটোভিসনের কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গেলো! আজ কে শিক্ষক, কে ছাত্র সব গুলিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তামার পাতের নীচ থেকে হৈ চৈ করতে করতে কিউপ্রিক আয়ন বেরোচ্ছে, চার্জে চার্জে তাদের যুদ্ধজয়ের আনন্দ, স্বাধীনতার আনন্দ।

কিন্তু আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা কই? ওরা কি ভাবছে, এই যে ইলেকট্রনদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে কপার সালফেটের জলীয় দ্রবণে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা, সে কি ওদের নিজেদের লড়াইয়ের গুণে শুধু? ওরা প্রার্থনা করলো বলেই তো আমি ব্যাটারির পজিটিভ প্রান্তটা লাগিয়ে দিলাম ওদের দেশের গায়ে। আজ যখন ওরা মুক্ত হলো, একটুও ধন্যবাদ দেবে না ওরা আমাকে?

তারপর ভাবলাম, ছিঃ! ভগবানের রাগ করা সাজে না। দেখাই যাক, শেষ অব্দি কি হয়?

এইভাবে ইলেকট্রনগুলোকে পেছনে ফেলে রেখে কিউপ্রিকের দল একটু একটু করে মিশে যাচ্ছিলো দ্রবণের লক্ষ কোটি কিউপ্রিক অণুর সাথে। কালীঠাকুরের মতো চতুষ্তলকীয় সালফেট আয়নের দল ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দিচ্ছিলো ওদের দিকে, একটু এদিক ওদিক হলেই ক্রিস্টালের জালে বেঁধে চুষবে ওদের চার্জ! ভাগ্যে জলের অণুসেনারা ছিলো, ব্ল্যাকক্যাটের মতো ছয়জনা মিলে পাহারা দিচ্ছিলো সাঁতার কাটতে থাকা প্রতিটা কিউপ্রিক আয়নকে।

পেছনে নীল সমুদ্রে টাইটানিকের মত ডুবতে ডুবতে গলছিলো বাদামী তামার অ্যানোড। সে এক দৃশ্য বটে!

এমনি সময় ঘটলো সেই নিশ্চিত বিপর্যয়টা! লক্ষ কোটি আর্ত চিত্কার বেরিয়ে এলো সেই জলীয় দ্রবণের ভেতর থেকে, “বাঁচাও, বাঁচাও”, “সামনে কারেন্ট, টানছে”, “ভাইসব, সামনে বিপদ, আর এগোবেন না”, “ফিরে চলো সবাই, হো কিউপ্রিক”, “ওরে তোর মাকে টেনে নিয়ে গেলো রে, ওরে আমার কি হবে রে”, এইরকম অজস্র শব্দে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলাম, ক্যাথোড মানে লোহার পেরেকটার দিকে। কারা যেন হাসছে ওর গায়ে বসে!
(ক্রমশঃ)...

©শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment