Wednesday 27 June 2018

পদার্থের জলসাঘরে

(বিশ্ববিখ্যাত রসায়নবিদ, নোবেল প্রাপক, শ্রী রোয়াল্ড হফ্ম্যানের লেখা কবিতা “পদার্থের এক অস্বাভাবিক অবস্থা” অবলম্বনে, শ্রী সত্যজিত্ রায় পরিচালিত “জলসাঘর” চলচ্চিত্রের ছায়াবলম্বনে, গুণীজনদের কাছে ক্ষমা চেয়ে এই কবিতা রচনা। মূল ইংরাজি কবিতাটি বিজ্ঞানী হফ্ম্যান রচিত কাব্যগ্রন্থ “দ্য মেটামিক্ট স্টেট” থেকে নেওয়া। কিছু কিছু কেলাস বা ক্রিস্টাল থাকে, যারা, তাদের ভেতরে থাকা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থের কারণে, আস্তে আস্তে ভেঙে পাউডারে বা গুঁড়োতে পরিণত হয়। এইরকম “হতকেলাস” অবস্থাকে মেটামিক্ট দশা বলে। এটাই কবিতার মূল বিষয়।)

পদার্থের জলসাঘরে

জমিদার বিশ্বম্ভর রায়, একবার জানতে চাইলেন,
“এ গৃহস্বামীর মতো একলা আর কাউকে চিনিস?”
আমি বললাম, “চিনি, হুজুর!
কেরলের সমুদ্রসৈকতে,
কিংবা, উত্তর ক্যারোলিনার কোনো এক নদীর চরায়, একরাশ বালির ভেতরে, একলা, খুব একলা, নিঃসঙ্গ এক খনিজের দেখা পাবেন।
শিলান্তরের পরে, শল্কমোচন হয়ে,
জন্ম নেওয়া এক টুকরো মোনাজাইট!”

“কেন? সে একলা কেন?
তার পেটে এতো পরমাণু, এতো বাঁধন,
তবু সে একা?”

আমি বললাম, “হুজুর, শুরুতে তারো ছিল সাজানো কেলাস, একটা গোছানো ল্যাটিস ছিল,
ওই দেখুন, আপনার মতো জলসাঘর,
ওস্তাদ কত নাচিয়ে---- সিরিয়াম, ল্যান্থানাম,
থোরিয়াম, ইট্রিয়াম,
আর ফসফেটের পরমাণুগুলো!
আসর জমিয়ে নেচে যেতো ওরা,
কোয়ান্টায়িত মূর্চ্ছনার তালে তালে,
স্থবিরা সৌদামিনীর রূপের টানে!
উফ্! সে কি দিন গেছে!
আপনি বোধহয় তখন নীচে নামতেন না,
তাই শোনেন নি, হুজুর!”

হুজুর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন! “তারপর, অনন্ত!”

আমি বললাম, “সর্ষের মধ্যে ভূত ছিলো, হুজুর!
থোরিয়াম, সে শুধু নাচতে আসে নি,
প্রকৃতির কাছে সে চেয়েছিল আরো বেশী কিছু!
না, পায় নি!
আর তাই ক্রোধোন্মত্ত থোরিয়ামকে দেখে,
তার পেটের নিউক্লিয়াসটা ভয়ে ফেটে গেছিলো!
থরের হাতুড়ি ঠোকার কি দরকার, হুজুর,
ঝড় যখন ভেতরে উঠেছে?

তারপর ল্যাটিসের এ কোণ থেকে ও কোণ অব্দি,
কাকে যেন খুঁজতে লাগলো, গামা রশ্মি,
নরকের অদৃশ্য সার্চলাইট!
নিউক্লিয়াসের হতভাগা অবশেষটুকু,
আলফা কণার নাম নিয়ে,
বেরিয়ে পড়েছিলো একলা,
অপরিকল্পিত হত্যালীলার মেগাভোল্ট লক্ষ্য নিয়ে!
পিছনে পড়েছিলো,
চরিত্রহত, ভাগ্যহত, আশাহত,
দিশাহীন একদলা পরমাণু!

জলসাঘরের ভেতর দিয়ে ছুটছিলো
কামানের গোলা, পালানোর রাস্তা কোথায়?
আশেপাশের আর কার কী হলো জানি না!
একের পর এক সংঘর্ষে,
সবাইকে ল্যাটিসহারা করে ছাড়লো, হুজুর!”

হুজুর বললেন, “জানি, সে সুদখোরের বেটি!
সব ভেঙে পড়ার শব্দ ওটা, হাতুড়ির গুমগুম নয়!
কিংবা বোমার আওয়াজও নয়।
উঃ! জানলাগুলো দে শিগ্গির,
দূরের, কাছের, সমস্ত নিয়ম, সমস্ত শৃঙ্খল,
যেন ভেঙে পড়ছে, ঝনঝনিয়ে!”

আমি বললাম, “আরো আগে যদি ভাবতেন,
স্বচ্ছ, নির্মল ক্রিস্টালকে,
এইভাবে বাদামী হলুদ গুঁড়োতে মিলাতে হতো না!”

বিশ্বম্ভর রায় বললেন, “দোষ,
ত্রুটি,
শূন্যতা,
উদ্বাস্তুর মতো,
শামুকের মতো, খোলের ভেতর ঢুকিয়ে রাখে,
ওর আর আমার, এই হতকেলাস দশা!
মোনাজাইটকে আমি চিনি, অনন্ত,
একা, একলা মন!”

© শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়

No comments:

Post a Comment